"তাফসীর ফী যিলালিল কোরআন - (৭ম খণ্ড)" বইটির সংক্ষিপ্ত আলোচনা অংশ থেকে নেয়াঃ এ সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ সূরাগুলাের অন্তর্ভুক্ত, ঠিক সূরায়ে আনয়াম-এর মতােই। এর আলােচ্য বিষয় তাই, যা অন্যান্য মক্কী সূরার মধ্যে সাধারণভাবে দেখা যায়। অর্থাৎ মানুষের অন্তরের গভীরে প্রােথিত আকীদা সম্পর্কিত বিশেষ আলােচনা। কিন্তু এসত্তেও এই একই বিষয়ের ওপর দুটি সূরার মধ্যে আলােচন্য কত বৈচিত্র্যময় তা লক্ষণীয়। আসলে আকীদা বিশ্বাসের বিষয়টি অত্যন্ত ব্যাপক আলােচনার দাবী রাখে। আল কোরআনের প্রত্যেকটি সূরাই স্বতন্ত্র কিছু বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। প্রত্যেকটির রয়েছে নিজের কিছু এমন বিশেষত্ন যা অপর সূরা থেকে তাকে আলাদা করে রাখে। প্রত্যেকের রয়েছে নিজের পৃথক বর্ণনাভংগি এবং প্রত্যেকের পৃথক পৃথক বৈশিষ্ট। এই একই বিষয়ের ওপর বিভিন্ন দিক দিয়ে ও বিভিন্ন ক্ষেত্রকে সামনে রেখে আলােচনা করা হয়েছে, কারণ বিষয়টি অতি বড়, অতি মহান। বিষয় ও লক্ষ্যের দিক দিয়ে চিন্তা করতে গেলে দেখা যাবে প্রত্যেকটি মক্কী সূরাতে রয়েছে একই সুরের মূছনা। এতদসত্তেও প্রত্যেকটির রয়েছে নিজস্ব স্বতন্ত্র দৃষ্টিভংগি, আকর্ষণীয় পৃথক পৃথক বর্ণনাভংগি ও পদ্ধতি এবং ক্ষেত্র ভেদে এ বিষয়টির ওপর বহু রূপের আলােচনা। এ লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্যেই বিভিন্ন সূরাতে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আলােচনা করা হয়েছে। আল কোরআনের মর্যাদা বুঝতে হলে আমাদের একবার সৃষ্টিকুলের মধ্যে মানুষের মর্যাদার দিকে তাকানাে প্রয়ােজন। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সৃষ্টি জগতের মধ্যে কেমন ধরনের আদর্শ বানিয়ে সৃষ্টি করেছেন! বিশ্বচরাচরে যতাে আদম সন্তান আমরা দেখছি, সবাই তাে মানুষ, প্রত্যেকের মধ্যেই মানুষের বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তার প্রত্যেকটি অংগ-প্রত্যংগ ও গঠন প্রণালীতে ও কর্মকান্ডে পরিদৃশ্যমান হয়ে রয়েছে মানবীয় সকল আকার-আকৃতি। এতদসত্তেও এদের মধ্যেই আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন রুপের মানুষ বানিয়ে দিয়েছেন। একজনের সাথে অন্য জনের কিছু বৈচিত্র্যময় সাদৃশ্য বর্তমান থাকা সত্ত্বেও বহু বিষয়ে তাদের মধ্যে রয়েছে পার্থক্য সৃষ্টিকারী দারুণ রকমের বৈসাদৃশ্য, যা মানুষ নামের পরিচয় ছাড়া অন্য কোনাে বিষয়ে তাদের একত্রিত করতে সক্ষম নয়। এভাবেই আমি মহাগ্রন্থ এই পবিত্র কালামের সূরাগুলােকে গণনার মধ্যে নিয়ে এসেছি। অনুভব করেছি এইভাবে এবং আল কোরআনের ছায়াতলে দীর্ঘকাল থেকে আমি এইভাবে বাস্তব জীবনে আল্লাহ পাকের এই পবিত্র গ্রন্থ বাস্তব কাজে প্রয়ােগ করেছি, দীর্ঘ দিন ধরে মােহব্বত করেছি এই পাক কালামকে এবং এর প্রত্যেকটি কথা ও নির্দেশকে প্রকৃতি সংগত ও আমার জীবনের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে দেয়ার জন্যে প্রতিটি মুহূর্তেই প্রেরণাদায়ক হিসাবে পেয়েছি। আর আমি আল কোরআনের মধ্যে এরপরই দেখতে পেয়েছি বহু প্রকার মানুষের মডেল। দেখেছি বিভিন্ন প্রকারের মানুষকে, যারা নিজেদের চেষ্টা বলে নিজেদের যােগ্যতা ও মান সম্ভ্রমকে। উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছে। দেখেছি কোরআনের ছোঁয়া বহু দুরবস্থাপন্ন ব্যক্তির অবস্থার আশাতীত উন্নতি। এই সকল মানুষ, যারা ভালাে হওয়ার চেষ্টা করেছে, তারা পরস্পর বন্ধু হিসাবে নিজেদেরকে পেয়েছে, তাদের প্রত্যেকেই সত্যপ্রিয় এবং একে অপরের সঠিক বন্ধু। প্রত্যেকেই সত্যিকারের প্রেমিক, যার অন্তর মােহব্বতে ভরা। এ মানব-প্রেমিক বন্ধুদেরকে আমি সচ্ছল দেখতে পেয়েছি, পেয়েছি তাদেরকে বিভিন্ন দিক দিয়ে সমৃদ্ধিশালী, সুন্দর ও পরােপকারী বন্ধু হিসেবে।
সাইয়েদ কুতুব (১৯০৬ - ১৯৬৬) হলেন একজন মিশরীয় ইসলামি চিন্তাবিদ এবং রাজনৈতিক সংগঠক। তিনি মিশরের ইসলামী আন্দোলনের প্রধান সংগঠন ইখওয়ানুল মুসলিমিন (মুসলিম ব্রাদারহুড) দলের মুখপত্র ইখওয়ানুল মুসলিমিন'এর সম্পাদক ছিলেন। তাকে তৎকালীন সরকার ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত করে। তিনি মিশরের উসইউত জিলার মুশা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মূল নাম হল সাইয়েদ; কুতুব তার বংশীয় উপাধি। তার পিতার নাম হাজী ইবরাহীম কুতুব; তিনি চাষাবাদ করতেন। তার মাতার নাম ফাতিমা হোসাইন উসমান। তারা মোট দুই ভাই এবং তিন বোন ছিলেন। তার অপর ভাই হলেন: মুহাম্মাদ কুতুব এবং বোনেরা হলেন: নাফীসা কুতুব, হামিদা কুতুব এবং আমিনা কুতুব। সাইয়েদ কুতুব ছিলেন সবার বড়। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাইয়েদ কুতুবের শিক্ষা শুরু হয়। শৈশবেই কুরআন হেফজ করেন। পরে তাজহিযিয়াতু দারুল উলুম মাদ্রাসায় শিক্ষা সমাপ্ত করে কায়রোর বিখ্যাত মাদ্রাসা দারুল উলুমে ভর্তি হন। ১৯৩৩ সালে ঐ মাদ্রাসা থেকে বি.এ. ডিগ্রি লাভ করেন এবং সেখানেই অধ্যাপক নিযুক্ত হন। তিনি শিক্ষা মন্ত্রোণালয়ের অধীনে স্কুল ইন্সপেক্টর নিযুক্ত হন। এবং এ-সময় আধুনিক শিক্ষা পদ্ধতি পড়ার জন্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়। তিনি দু’বছরের কোর্স শেষ করে বিদেশ থেকে দেশে ফিরে আসেন। ১৯৫৪ সালে তাকে বন্দি করে মিসরের বিভিন্ন জেলে রাখা হয়। তিনি ছিলেন মিসরের প্রখ্যাত আলেম ও সাহিত্যকদের অন্যতম। ছোটদের জন্যে আকর্ষণীয় ভাষায় নবীদের কাহিনী লিখে তার সাহিত্যক জীবনের সূচনা। পরবর্তীকালে ‘আশওয়াক’ (কাটা) নামে ইসলামি ভাবধারার একটি উপন্যাসও রচনা করেন।