ফ্ল্যাপে লিখা কথা লড়াই, সংঘাত, যুদ্ধ-এসব মানব সভ্যতার পূর্ব থেকেই সমাজে বিদ্যামান ছিল। তাত্ত্বিকভাবে মনে করা যেতে পারে, সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধ-লড়াই থামতে থাকবে। কিন্তু দুনিয়ার ইতিহাসে এ ঘটনা ভিন্নতর হয়েছে। মানুষ দিন দিন আসবাবগতভাবে যতো সভ্য হয়েছে তার চেয়ে বেশি হয়েছে বন্য।
জাতিতে জাতিতে, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে, একই রাষ্ট্রের ভেতরে গোষ্ঠিতে গোষ্ঠিতে , সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে লড়াইয়ের মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণ, পটভূমি এবং এর পরিণাম অনুসন্ধান করলে যুদ্ধের পক্ষে কোন যুক্তিই খুঁজে পাওয়া যাবে না। ইতিহাসে দেখা যাচ্ছে, যে জাতি বা রাষ্ট্র যতো বেশি উন্নত ও সভ্য বলে পরিচিত হয়েছে, তারা ততো বেশি যু্দ্ধবাজ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যুদ্ধ এভাবে আদিতে ছিল, এখনো আছে। যুদ্ধে স্বভাবগতরূপে এখনও ঐসব জাতিই যুদ্ধবাজ হিসেবে বিরাজিত, যাদের বর্তমান পৃথিবীতে মনে করা হয় সবচেয়ে উন্নত, সম্পদশালী, শিক্ষিত, আরো কতো কি! কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোন কিছুই শান্তি আনেনি, বরং যুদ্ধ অশান্তি ছড়িয়ে দিয়েছে মানুষের মনে, মননে এবং সমাজে।
শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে শিকার যারা হয়েছে, তারা আর কেউ নয়, নারী এবং শিশুরা, যাদের যুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কই ছিল না। যুদ্ধের কারণে একজন পুরুষ নিহত হলেও নারী-শিশু তাতেও ক্ষতিগ্রস্থ। এতে হয় নারী বিধবা হয়েছে, নয় শিশু পিতৃহীন। পৃথিবীর এখনো অনেক দেশ আছে যেসব দেশের শিশুদের ঘুম ভাগে গোলার আওয়াজে।
অথচ কি বিস্ময়কর চিত্র যে, যারা যুদ্ধ করছে অথবা যুদ্ধ চাপিয়ে দিচ্ছে অন্যের উপর, তাদের দেশেই লক্ষ কোটি বেকারত্ব। শিশুরা খেতে পায় না এমন অনেক দেশ আছে, অথচ সেসব দেশের রাষ্ট্রনায়করা পারমাণবিক বোমা বানাচ্ছেন। কি তাদের উদ্দেশ্য, কোনটা তাদের লক্ষ্য! এসব দেশের রাষ্ট্রনায়করা, বিজ্ঞানীরা, তাদের সমর্থকগোষ্ঠী সবাই যে মানসিকভাবে অসুস্থ তা সহজেই বোঝা যায়।
ড. মোহাম্মদ হাননান-এর প্রধান পরিচয় বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে গবেষক হিসেবে। এদেশের ছাত্রদের ইতিহাসকে এখন পর্যন্ত একমাত্র তিনিই বাণীবদ্ধ করে রেখেছেন (দশ খণ্ডে) । এছাড়া ইতিহাস এবং অন্যান্য সামাজিক ইতিহাস ( বাংলাদেশে ফতোয়ার ইতিহাস, বাঙালি মুসলমানের নাম, বাঙালি মুসলমানের পদবী) ইত্যাদি গ্রন্থ লিখেও তিনি খ্যাতি অর্জন করেছেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা এখন সত্তর। ‘শিশুরা যু্দ্ধ চায় না’- ড. হাননানের পরিশ্রমলব্ধ নতুন কাজ। দলিল, আলোকচিত্র, রিপোর্ট সহযোগে তিনি বর্তমান দুনিয়ার বিভিন্ন যুদ্ধ ক্ষেত্রকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। যে কোন বিবেকবান মানুষকে এ গ্রন্থ নাড়া দেবে। শিশুরা যুদ্ধে শিকার হয়ে কি অবর্ণণীয় অসহায় অবস্থার মধ্যে পতিত হয়েছে, দালিলিক এ গ্রন্থ দেখে যুদ্ধবাজদেরও যদি কিছুমাত্র বোধদয় হয়!
ড. মােহাম্মদ হাননান সহস্রাব্দ ও শতাব্দীর ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইত্যাদির ওপর যে। সংগ্রহ-সংকলনটি করেছেন তা অনুসন্ধিৎসু যে-কোনাে পাঠকের কাছেই বিশ্বকোষের স্বাদ এনে দেবে। শতাব্দীর বাংলাদেশ, শতাব্দীর বিশ্ব, সহস্রাব্দের বাংলাদেশ, সহস্রাব্দের বিশ— গ্রন্থ চারটিকে নানাভাবেই সাজানাে যায়। এখানে পাঠক বাংলাদেশকে পাবেন দু’ভাবে-শতাব্দী ও সহস্রাব্দের মতাে করে, আবার বিশ্বকেও পাবেন শতাব্দীর পাশাপাশি সহস্রাব্দের পটভূমিতে। শতবছর অথবা হাজার। বছরের পরিক্রমায় বাংলাসমাজ ও বিশ্বসমাজ এভাবেই গ্রন্থ চারটিতে মূল্যায়িত হয়েছে।