ফ্ল্যাপে লিখা কথা ঐন্দ্রজালিক দৃশ্য রচনা, মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনা, বিষাদাত্মক ধারাভাষ্য কিংবা জীবন ও সংগ্রামের আরেক অধ্যায় ‘নির্বাসিতের জার্নাল’- প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রাণ প্রিয় স্বদেশ, বাবা-মা, প্রিয়তমা পত্নী, পুত্র-কন্যা-ভাইবোন-আত্মীয়-স্বজন-কর্মী-সহযোদ্ধা সকলের প্রতি অকৃত্রিম অনুরাগের দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠস্বর।
১৯৭৫ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত লিখিত পত্রগুলোয় বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ড এবং পরবর্তী দেশচিত্র রক্তরেখায় রঞ্জিত। অধিকন্তু ব্যক্তিজীবনের টানাপড়েনের সঙ্গে রাজনৈতিক অমানিশা। পারিবারিক, সামাজিক, দৈশিক জীবনের বৃত্ত পেরিয়ে চিঠিগুলোর ব্যঞ্জনা বৈশ্বিকতায় উত্তরিত। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর শুরু হয় আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর আরেক জীবন- ভারতে নির্বাসনের মধ্য দিয়ে িএই নির্মম হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কার্যক্রম। প্রিয় নেতাকে হারিয়ে রক্তাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়ে স্ত্রী-পুত্র-কন্যাহীন প্রবাসে বসে নিয়মিত চিঠি লিখতে থাকেন। কখনো কলকাতায়, কখনো-বা শিলিগুড়ি, ত্রিপুরা, আসাম, মিজোরাম কিংবা দিল্লিতে বসেই চলতে থাকে বাস্তব ও স্বপ্নের জালবিস্তার। এই বিস্তৃত জালের টানে নড়ে ওঠে টাঙ্গাইল-ঢাকাসহ বাংলাদেশেল হৃদয়। সেই চিঠিগুলোই গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলো। সমগ্র দেশচিত্রের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা তাঁর লেখায় সমকালীন সময়ের আলোকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়ে ওঠে। একদিকে পত্ররস অন্যদিকে মর্মজ্বালা, একদিকে প্রত্যাশা অন্যদিকে প্রেমহীনতা গ্রন্থটিকে অনন্য দেশপ্রেমের মর্যাদায় অভিষিক্ত করে।
‘নির্বাসিতের জার্নাল’ পাঠে আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর চোখে দেখা বাংলাদেশ ও মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন-সম্ভাবনায় পাঠক আবেগাপ্লুত হবে।
ভূমিকা চিঠি লিখেছিলাম নানা জনকে, নানা কারণে। কালপ্রবাহে আমার অপ্রকাশিত অন্তর্লীন লেখকসত্তাটি স্বাতন্ত্রিক বৈশিষ্ট্য সমুজ্জ্বল- পাঠক-সমালোচক-শুভানুধ্যায়ীরা সে-কথাই বলেন। ‘নির্বাসিতের জার্নাল’ পাঠে তাদের এই ধারণা বহুমাত্রিকতায় ঋদ্ধ হবে বলে মনে হয়। এই সত্তার কোনোটি রাজনীতিকের, কোনোটি লেখক-পাঠকের কিংবা শিক্ষানুরাগীর- সব মিলিয়েই লতিফ সিদ্দিকী। প্রবাসে বিভিন্ন ঘটনায় ও বিষয়ে সংশ্লিষ্টের সঙ্গে যেমন পত্রালাপ করেছি তেমনি আপনজন ও প্রিয়জনের সঙ্গেও। আপনজনদের সঙ্গে আটপৌরে যে-জীবন তার দায়মুক্ত হওয়া সম্ভব নয় বলে যাপিত জীবনের কথা প্রাধান্য পেয়েছে। উঠে এসেছে দাম্পত্যজীবনে চড়াই-উৎরাই ও জঙ্গমতা। অস্তিত্বের টানাপড়েন যেখানে মুখ্য সেখানে প্রতিটি চিঠিতে আমার বোধ-বিশ্বাস যে প্রাধান্য পাবে তা বলাই বাহুল্য।
কয়েকটি গ্রন্থ প্রকাশের পর স্বীয় ভুবন মেলে ধরার দুরন্ত সাহস সঞ্চয় হয়। শুভানুধ্যায়ীরা ভাবেন অপ্রকাশিত এই জগৎ জনসমক্ষে তুলে ধরার এখনই সময়। মনোজগতিক চেতনা ও প্রণোদনায়, প্রকাশকের নিয়ত আগ্রহে বইটি প্রকাশ পেল। একক কোনো ব্যক্তির প্রতি আমার দায় স্বীকারের সুযোগ নেই। পুরো সমাজ এবং আমি যে-বলয়ের বাসিন্দা সেখানকার সবার কাছে কৃতজ্ঞ।
১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে নির্মম হত্যার পর ভারতে নির্বাসিত হই। দেশে ফিরে নির্বাসনের অবসান ঘটলেও সামরিক সরকারের রোষানলে পড়ে কারারুদ্ধ হই, মুক্তিও পাই। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিসহ আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক কারণে নিজের ভেতরে নিজেকে বেঁধে ফেলি।। বৃত্তাবদ্ধ-নির্বাসিত জীবনের কষ্টকথা গ্রন্থটির প্রাণবীজ। অধিকন্তু দ্বন্দ-সংঘাতময় প্রাত্যহিক জীবনের কথকতার মলাটবন্দী এই আয়োজন।
আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর রাজনৈতিক জীবনের শুরু বিংশ শতকের মধ্য-পাঁচের দশক থেকে। বেড়ে-ওঠা বাংলাদেশের এক সাবেক মহকুমা এবং বর্তমানে জেলা শহরের এক প্রত্যন্ত গ্রামে, এক মধ্যবিত্ত। পরিবারে। সেখান থেকে জাতীয় রাজনীতির মূল ধারাপ্রবাহে উঠে আসা এবং এখনও রাজনীতিই যার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান, তাঁর মতাে একজন মানুষকে অতিক্রম করতে হয়েছে জীবনের নানা গলিখুঁজি, রাজনীতির নানা কালপর্ব; সইতে হয়েছে জেল-জুলুম ও চরম নিগ্রহ। মহান মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় সংগঠন ও অংশগ্রহণে যার জীবন ধন্য, সংসদীয় রাজনীতির চর্চায় একাগ্র নিষ্ঠ, বঙ্গবন্ধুর সাহচর্যে যার জীবন ঐশ্বর্যময়, জন্মস্থানের সীমিত পরিসরে হলেও কষি ও কষকের। জীবনমানের উন্নয়নে যৌথখামার এবং দেশের শিক্ষাবিস্তারে স্বউদ্যাগে স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা নেপথ্যের সংগ্রামময় কাহিনী, শেষত বঙ্গবন্ধুর নিষ্ঠুর মৃত্যু পরবর্তী প্রতিরােধ-সংগ্রামের অন্যতম প্রধান। সংগঠকের যে দীর্ঘ পাঁচ দশকের সক্রিয় প্রগাঢ় রাজনৈতিক জীবন- এ সবকিছুরই ধারাবাহিক বিবরণভাষ্য জীবনীর আকারে তুলে ধরা হয়েছে এই গ্রন্থে।