নোবেলপ্রাপ্তির পর বিশ্বের দরবারে তিনি তখন সুপরিচিত, স্বনামধন্য। ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, ডেনমার্ক ইত্যাদি বিভিন্ন দেশে বক্তৃতা দিয়েছেন। উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বভারতীর জন্য অর্থ সংগ্রহ। আর তাঁর বক্তৃতার বিষয়বস্তু ছিল মূলত ভারতীয় দর্শন এবং তাঁর নিজস্ব ধর্মভাবনা। আশৈশব উপনিষদের প্রভাবে লালিত রবীন্দ্রনাথ তার মর্ম অনুধাবন করেছিলেন এবং তার প্রতি গভীরভাবে শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। বিদেশে প্রদত্ত তাঁর একাধিক ভাষণে উপনিষদের প্রসঙ্গ এবং তাঁর জীবনে ও মননে তার প্রভাব একাধিকবার উল্লেখিত হয়েছে। আর সেই সঙ্গে উপস্থাপিত হয়েছে তাঁর নিজস্ব ধর্মভাবনা যার মূলে ছিল প্রকৃতির প্রতি এক অতি নিবিড়, অতি গভীর প্রেম। প্রকৃতির দৈনন্দিন কার্যকলাপ ও প্রকাশের .. সঙ্গে যেন নাড়ির যোগ অনুভব করতেন। তিনি। তাঁর নিজের ভাষায়-‘প্রকৃতির.... মধ্যে যে এমন একটা গভীর আনন্দ? পাওয়া যায়, সে কেবল তার সঙ্গে আমাদের একটা নিগুঢ় আত্মীয়তা অনুভব করে। এই তৃণগুল্মলতা, জলধারা, বায়ুপ্রবাহ, এই ছায়ালোকের আবর্তন, জ্যোতিষ্কদলের প্রবাহ, পৃথিবীর অনন্ত প্রাণীপর্যায়, এই সমস্তের সঙ্গেই আমাদের নাড়ী-চলাচলের যোগ রয়েছে...।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, চিত্রশিল্পী, সংগীতস্রষ্টা, অভিনেতা, কন্ঠশিল্পী, কবি, সমাজ-সংস্কারক এবং দার্শনিক। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য প্রথম বাঙালি হিসেবে ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে তৎকালীন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে কলকাতার ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিমনা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ভানুসিংহ ঠাকুর ছিল তাঁর ছদ্মনাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই মানেই এক মোহের মাঝে আটকে যাওয়া, যে মোহ পাঠককে জীবনের নানা রঙের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয় নানা ঢঙে, নানা ছন্দে, নানা সুর ও বর্ণে। তাঁর ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাট্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর কিছুদিন পরই আলোর মুখ দেখে। কাবুলিওয়ালা, হৈমন্তী, পোস্টমাস্টারসহ মোট ৯৫টি গল্প স্থান পেয়েছে তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থে। অন্যদিকে ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ১,৯১৫টি গান। উপন্যাস, কবিতা, সঙ্গীত, ছোটগল্প, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনীসহ সাহিত্যের সকল শাখাই যেন ধারণ করে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমূহ। তিনি একাধারে নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা দুই-ই ছিলেন। কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া তিনি চিত্রাংকনও করতেন। তৎকালীন সমাজ-সংস্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমগ্র। তাঁর যাবতীয় রচনা ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে ত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। আজও আমাদের বাঙালি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে বিশ্বকবির সাহিত্যকর্ম।