প্রেক্ষাপট অথবা মানবমনের অন্তরঙ্গ অনুভূতির প্রকাশ-মাধ্যম এবং বিভূতিভূষণের রচনায় এই দ্বিতীয় সম্পর্কের কথাই সবচেয়ে বেশি বলা হয়েছে। বস্তুত বিভূতিভূষণকে প্রকৃতির কাব্যকার বললে হয়তো অন্যায় কিছু বলা হবে না, যদি আমরা সর্বদাই মনে রাখি যে প্রধানত তিনি মানুষের ইতিহাস-রচয়িতা-মানুষের সুখদুঃখের পাঁচালীই তাঁর সাহিত্যের সর্বপ্রধান উপজীব্য। তাই তাঁর চরিত্র-চিত্রণ বৈশিষ্ট্যই আমাদের কাছে সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক বলে মনে হয়। - বিভূতিভূষণের কেন্দ্রীয় নারীচরিত্রের মধ্যে প্রায় কাউকেই কোন অর্থে অসাধারণ বলে বর্ণনা করা চলে না। এরা অধিকাংশই অতি সাধারণ নারী-অশিক্ষিতা, অপ্রগল্ভা ও সরলস্বভাবা। (ব্যতিক্রম দুই- একটি আছে, যেমন 'পথের পাঁচালী'-'অপরাজিত'-র লীলা অথবা 'আরণ্যক' এর ভানুমতী।) তাছাড়া এরা সবাই আদর্শ নারীহৃদয় বলতে বিভূতিভূষণ নিজে যা বুঝতেন সেই বিশিষ্ট ধরনের নারীহৃদয়ের অধিকারিণী, অর্থাৎ এদের হৃদয়ে রোমান্টিক প্রেম কিংবা অতি-মানবিক মহত্ত্বের চেয়ে ঘরোয়া মায়া-মমতা ও প্রীতি-হের স্থান অনেক বেশি উঁচুতে। আরও একটা কথা, এরা বড় একটা বদলায় না, শরৎচন্দ্রের নারীচরিত্রের মত শেষ পর্যন্ত সুগভীর তাৎপর্যবহ বা সুদূর-প্রসারী সম্ভাবনাময় কোন কিছু করে বসে না। এরা বরাবর যা ছিল চিরকাল তাইয় রয়ে যায়। চরিত্র হিসাবে এরা static, dynamic নয়। এদের জীবনের মৌল বৈশিষ্ট্য Becoming নয়, Being -কিন্তু বিভূতিভূষণের পুরুষ-চরিত্রগুলিকে এই অর্থে কদাপি 'সাধারণ' বলা যায় না। অন্য কোন গুণ এদের থাক বা না থাক, সবাই এরা অল্পাধিক পরিমাণে অসাধারণ। কেউ কেউ একটু ছিটগ্রস্ত বা বাউন্ডুলে খ্যাপাটে ধরনের লোক, কারও কারও মধ্যে অস্পষ্ট ও ঈষৎ বিভ্রান্ত আদর্শবাদের সন্ধান মেলে, কোন-কোনজন হয়তো উদাসীন আপন-ভোলা
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হৃদয়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, দিনলিপি ইত্যাদি। প্রখ্যাত এই সাহিত্যিক ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল যশোর জেলায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর প্রথম বিভাগে এনট্রান্স ও আইএ পাশ করার মাধ্যমে। এমনকি তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করেন। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো 'পথের পাঁচালী', যা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়ার মাধ্যমে। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই এর মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো 'আরণ্যক', 'অপরাজিত', 'ইছামতি', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল', 'দেবযান' ইত্যাদি উপন্যাস, এবং 'মৌরীফুল', 'কিন্নর দল', 'মেঘমল্লার' ইত্যাদি গল্পসংকলন। ১০ খণ্ডে সমাপ্ত ‘বিভূতি রচনাবলী’ হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র, যেখানে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছে তার যাবতীয় রচনাবলী। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর বিহারের ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর 'রবীন্দ্র পুরস্কারে' ভূষিত হন।