তাকাফুল' কথাটি আরবি শব্দ ‘কাফাল’ থেকে উদ্ভব হয়েছে- যার অর্থ কারও প্রয়োজন পূরণের দায়িত্ব গ্রহণ করা। আফ্রিকার সুদানে ইসলামী বীমার প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক সূত্রপাত হলেও বর্তমানে এশিয়া মহাদেশে ইসলামী বীমার ব্যাপক বিস্তৃতি ও প্রসার ঘটেছে। বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ হিসেবে স্বাভাবিকভাবে আশা করা যায় যে, ইসলামী বীমার প্রচার, প্রসার ও ব্যাপকতার সম্ভাবনা এদেশে অনেক বেশি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ইসলামী বীমার উপর গবেষণালব্ধ তেমন কোন বই ইতোপূর্বে প্রকাশিত হয়নি। অথচ ব্যাংক-বীমা ব্যবস্থা এমনকি উচ্চ শিক্ষায় অর্থনীতি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কোর্সে এর চাহিদা বিদ্যামান। জীবনে ঝুঁকি আছে এবং ঝুঁকি নিয়ে আমাদের চলতে হয়। ঝুঁকি নিরসনের একটি বৈজ্ঞানিক পথ ও পদ্ধতির নাম বীমা। বীমা একটি অর্থনৈতিক প্রয়োজন। বীমার লক্ষ্য হলো ব্যক্তি বিশেষকে জীবন, স্বাস্থ্য ও সম্পদের ঝুঁকি থেকে রক্ষা করা। বীমার ধারণা ইসলামী মূলনীতির কাঠামোর মধ্যে গ্রহণযোগ্য। কিন্তু তাকাফুলের শরীয়াহ সম্মত ধারণা সনাতন বীমা পদ্ধতিতে অনুপস্থিত। ইসলাম সহজাতভাবেই নির্ভরযোগ্য ঝুঁকি পূরণের ধারণার পক্ষে। অতএব, বর্তমানে যে পদ্ধতিতে বীমা ব্যবসা পরিচালনা করা হয় তার পরিবর্তে ‘সকলের তরে সকলে আমরা' নীতির উপর ভিত্তি করে বীমা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সম্ভব। ইসলামী বীমা (তাকাফুল) প্রচলিত বীমার একটি বিকল্প ব্যবস্থা যা ইসলামী আদর্শের অনুসারীদের পারস্পরিক আস্থা ও সহযোগিতা ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত একটি সামাজিক ব্যবস্থা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলিম জনগোষ্ঠি পারস্পরিক সহযোগিতার লক্ষ্যে নিজস্ব পন্থায় অর্থনৈতিক দায়ভার ভাগ করে নেয়ার জন্য এখন তাকাফুল ব্যবস্থার অনুসরণ করছে। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। মানুষের সারা জীবনের সকল বিষয়েরই দিক নির্দেশনা এতে আছে। বীমা প্রকৃত অর্থে মানুষের জীবনে বিভিন্ন বিপত্তির ক্ষেত্রে জরুরি। অবস্থা মোকাবেলার একটি আর্থিক নিরাপত্তা পদ্ধতি। পারস্পরিক সহযোগিতার নীতি অনুযায়ী সুদমুক্তভাবে ও স্বচ্ছ লেনদেনের ভিত্তিতে বীমা ব্যবস্থা পরিচালনা করা হলে তা ইসলাম বিরোধী হবে না। ইসলামী বীমা একটি সহযোগিতামূলক ব্যবস্থা যেখানে পারস্পরিক কল্যাণ সাধনের মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার ঝুঁকি থেকে ব্যক্তি ও সমাজ উপকৃত হয়ে থাকে। ইসলামী জীবনবীমা এমন একটি পদ্ধতি যাতে একদল মানুষ তাদের মধ্যকার কোন সদস্যের দুর্ঘটনাজনিত শারীরিক অক্ষমতা কিংবা মৃত্যুর ফলে সৃষ্ট ক্ষতির বোঝা লাঘবের জন্য একে অপরের সাথে সহযোগিতা করে। ঝুঁকি মোকাবেলা করার জন্য পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইসলামী বীমার প্রবর্তন হয়েছে এবং সফলতার সাথে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আমাদের দেশেও এ ব্যবস্থা ইতোমধ্যে জনগণের মাঝে সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশের বীমা শিল্প বিভিন্ন ধরনের সমস্যার আবর্তে আটকে আছে। একদিকে মানুষ আগের তুলনায় অনেক বেশি বীমার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে বীমা সম্পর্কে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন বিভ্রান্তি। বিশেষ করে ইসলামী বীমা সম্পর্কে আমাদের রয়েছে স্বচ্ছ ধারণার অভাব। এই জটিল অবস্থার মধ্য দিয়েই ঘটছে বীমা শিল্পের ক্রমবিস্তৃতি। বর্তমানে এই শিল্পে জড়িয়ে রয়েছে হাজার হাজার পোশাজীবী ও লক্ষ লক্ষ বিক্রয় কর্মী। বীমা শিল্পের খুঁটিনাটি অনেক বিষয় নিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু তেমন গভীরে যাবার মত ফুরসত অনেকের হচ্ছে না। সেজন্যই এই সংকলন গ্রন্থের প্রকাশনা অনেকেরই কাজে লাগবে এবং উপকারে আসবে।
কাজী মো. মোরতুজা আলী বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট ফর প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্টের (বিআইপিডি) মহা পরিচালক, জেনিথ ইসলামী লাইফের নিরপেক্ষ পরিচালক ও ভাইব্র্যান্ট এনডেভারস লিমিটেড এর পরিচালক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনায় সম্মানসহ স্নাতকোত্তর এবং পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে আইন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। তিনি ১৯৭০ সালে হাবিব ব্যাংকের জুনিয়র অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। অগ্রণী ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের বাণিজ্যিক কর্মকর্তা এবং মহা-ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৫ হতে ২০০২ পর্যন্ত দীর্ঘ সাত বছর তিনি বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স একাডেমীর প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি প্রাইম ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। তিনি ইসলামিক ইকোনমিক্স রিসার্চ ব্যুরোর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও ফেলো। পেশাগত দক্ষতা অর্জনের লক্ষ্যে তিনি ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট, শিপিং এবং বীমার উপর উচ্চতর ডিপ্লোমা ডিগ্রী অর্জন করেছেন। তিনি নরওয়েজিয়ান শিপিং একাডেমীর (অসলো) একজন ফেলো এবং চার্টার্ড ইন্স্যুরেন্স ইনস্টিটিউট লন্ডন-এর এসোসিয়েট (এসিআইআই)। এশিয়া প্যাসিফিক রিস্ক এন্ড ইন্স্যুরেন্স এসোসিয়েশন সিংগাপুর এবং বাংলাদেশ সোসাইটি অব ট্রেনিং এণ্ড ডেভেলপমেন্টের সদস্য। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গঠিত বীমা আইন সংস্কার ও নতুন ইসলামী বীমা আইন প্রবর্তনে বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করছেন। পেশাগত যোগ্যতার স্বীকৃতি স্বরূপ ভারতীয় ইন্স্যুরেন্স ইনস্টিটিউট- এর এস কে দেশাই এ্যাওয়ার্ড অর্জনসহ তিনি ২০০৪ সালে বেস্ট ইন্স্যুরেন্স প্রফেশনাল হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। বীমা ও ইসলামী জীবন বীমার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের সংগে সম্পৃক্ত থেকে তিনি বিশ্বের ১৭টি দেশ সফর করেছেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বিভিন্ন মিডিয়ার ‘টক শো' সমূহে তার নিয়মিত উপস্থাপনা অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে? তার প্রকাশিত অন্যান্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে- “ইসলামী জীবনবীমা বর্তমান প্রেক্ষিত”, “বিশ্বাস ও আত্মউন্নয়ন”, “Introduction to Islamic Insurance”, “কুরআনের আলোয় আলোকিত মানুষ”, ‘ইসলামী জীবন বীমার জানা অজানা’, ‘সহজ ভাষায় প্রচলিত ও ইসলামী জীবন বীমা’, ‘কুরআনের বাণী ও আমাদের করণীয়’, বাংলাদেশে জীবন বীমা’ ও “চলার পথে ইসলাম”।