আলিমরা নবিদের উত্তরাধিকারী। নবিরা দিনার কিংবা দিরহামের উত্তরাধিকার রেখে যান না; তারা উত্তরাধিকার রেখে যান শুধু ইলমের। তাই যে এই নববি ইলমকে ধারণ করে, সে নবিদের উত্তরাধিকারের পূর্ণ অংশ লাভ করে। যে ইলম অর্জন করেছে আর যে ইলম অর্জন করে নি—এই দুই শ্রেণি কখনোই সমান হবে না। আবিদের ওপর আলিমের শ্রেষ্ঠত্ব তেমন, আকাশের নক্ষত্ররাজির ওপর পূর্ণিমার রাতের শুভ্রোজ্জ্বল চাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব যেমন। এ জন্যই তো আলিমের সম্মানার্থে মহান ফিরেশতাগণও নিজেদের ডানা বিছিয়ে দেন। আকাশসমূহ এবং পৃথিবীর সকল কিছু আলিমের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করে। এই ইলম যার-তার নসিবে জোটে না। রাসুলুল্লাহ বলেন, “এই ইলমকে ধারণ করবে প্রত্যেক পরবর্তী প্রজন্মের আস্থাভাজন শ্রেণি। তারা এর থেকে নিরোধ করবে সীমালঙ্ঘনকারীদের বিকৃতি, বাতিলপন্থীদের মিথ্যাচার এবং মূর্খদের অপব্যাখ্যা।” কুরআন-সুন্নাহর ভাষ্যানুযায়ী একজন আলিমের কাজ হলো যথাক্রমে—সুগভীর জ্ঞানার্জন করা (অন্য ভাষায়, ‘রুসুখ ফিল-ইলম’ অর্জন করা), দ্বীনের পূর্ণাঙ্গ ফিকহ হাসিল করা (অন্য ভাষায়, ‘তাফাক্কুহ ফিদ্দ্বীন’ হাসিল করা), আল্লাহ তাআলার ভয় এবং তাকওয়া নিজের মধ্যে আনা, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ধারাবাহিকভাবে চলে আসা ইলম-আমল-আখলাক এবং বিশুদ্ধ চিন্তা-চেতনা ভেতরে ধারণ করে মহান সালাফেসালেহিনের রঙে নিজেকে রঙিন করা, এরপর উম্মাহর সৎকর্মপরায়ণশীলদের জান্নাত ও আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামতের সুসংবাদ প্রদান করা আর অপরাধীদের আসন্ন শাস্তি ও পাকড়াও সম্পর্কে সুস্পষ্ট সতর্ক করা এবং আমৃত্যু ইলমের প্রচার-প্রসার ও ইলম অনুযায়ী আমলের ধারা অব্যাহত রাখা। এর পাশাপাশি একজন আলিমের জন্য জরুরি হলো, তার ইলমকে সকল প্রকার দোষত্রুটি এবং ক্লেদ থেকে মুক্ত রাখা, ইলমের একজন ধারক-বাহক হিসাবে নিজের শান এবং গায়রত অক্ষুণ্ণ রাখা। কোনোভাবেই ইলমের মর্যাদাহানি না করা, এই মর্যাদাপূর্ণ ইলমকে নিয়ে দুনিয়াবাসীর দুয়ারে দুয়ারে ছোটাছুটি করে ইলমকে হেয় এবং কালিমালিপ্ত না করা। কোনটা প্রকৃত ইলম আর কোনটা অপ্রকৃত ও বাহ্যিক ইলম—দুনিয়ায় বসে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া দুরূহ। দুনিয়ায় সবকিছুর ফায়সালা হয় বাহ্যিক অবস্থার ভিত্তিতে। এখানে কারও অন্তর চিড়ে ভেতরগত অবস্থা প্রত্যক্ষ করা যায় না। এ কারণেই তো রাসুলুল্লাহ এর ওফাতের পর সুনির্দিষ্টভাবে কাউকে পারিভাষিক ‘মুনাফিক’ আখ্যা দেওয়ার অবকাশ নেই। হাঁ, বর্তমান পরিভাষায় ‘যিন্দিক’ এবং ‘মুলহিদদের’ ‘মুনাফিক’ বলা হয়—তা ভিন্ন কথা। কিন্তু কুরআন-সুন্নাহয় যে ‘মুনাফিকে’র আলোচনা বার বার এসেছে, ওহির দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সেই ‘মুনাফিক’কে চিহ্নিত করা এখন শুধু দুরূহই নয়; বরং অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা ইলম আহরণের যথাযথ পন্থায় পূর্ববর্তী আলিমদের থেকে ইলম শেখে, আর তাদের যোগ্যতা, বিজ্ঞতা এবং প্রাজ্ঞতার ব্যাপারে সমকালীন বিদগ্ধ আলিম এবং ফকিহরা স্বীকৃতি দিয়ে থাকে, বাহ্যত তাদের আলিম হিসাবে গণ্য করা হয়ে থাকে। পূর্বে যেহেতু এভাবে ইলম অর্জনের প্রাতিষ্ঠানিক ধারা ও পদ্ধতি এবং নির্ধারিত মেয়াদি নেসাবের প্রচলন ছিল না, তাই কেউ যোগ্য আলিম হিসাবে বিবেচিত হওয়ার জন্য সমকালীন আলিমগণের স্বীকৃতির ঢের মূল্য ছিল। বর্তমানকালে ইলমের অধঃপতনের যুগে তো আলিম হওয়ার মাপকাঠিই নির্ধারণ করা হয়েছে নেসাবের নির্ধারিত মেয়াদ পূর্ণ করা। যে কেউ যেকোনো উপায়ে এই মেয়াদ পূর্ণ করে, তার নামের শুরুতেই আলিম অভিধা যুক্ত হয়ে যায়। ইসলামি শরিয়াহর বিশেষ পরিভাষা ‘মুফতি’ শব্দের ওপর অবিচারের মাত্রা এ যুগে এত বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে—ইতিহাস বোধহয় কখনো এরূপ ভয়াবহ অবস্থা প্রত্যক্ষ করেনি। এ সকল আলিমরূপীদের প্রকৃত অবস্থান নববি ইলম থেকে যোজন যোজন দূরে, উম্মাহর ধারাবাহিক চিন্তা-চেতনা থেকেও তারা একেবারে রিক্তহস্ত, এরপরও সমাজ তাদের আলিমদের সারিতেই গণ্য করে। যার ফলে পরে এদের দ্বারা ইলম এবং উলামার প্রচুর মর্যাদাহানি হয়। তারা যে ইচ্ছাকৃতভাবে ইলম এবং উলামার গায়ে কালিমা লেপন করে—সবক্ষেত্রে বিষয়টি এমন নয়। তবে পাকার আগেই রং মেখে ফল বাজারে তোলা হলে তাতে ক্রেতামাত্রই বিভ্রান্ত হতে পারে—এটা নিশ্চয়ই অস্বাভাবিক নয়। আর এতে বিস্ময়েরও কিছু নেই। যারা প্রকৃত আলিম, কখনো তাদেরও পদস্খলন হয়। তবে পরিতাপের বিষয় হলো, একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী আলিম অর্থের লোভে পড়ে কিংবা পার্থিব মোহমুগ্ধ জীবনের তুচ্ছ স্বার্থের সামনে পরাজয়বরণ করে নিজেদের ইলমের সঙ্গে খিয়ানত ও দাগাবাজি করে বসে, তারা এই দুনিয়ার স্বল্পমূল্যের বিনিময়ে নিজেদের দ্বীন ইমান এবং ইলমকে সহাস্যবদনে বিকিয়ে দেয়। তারা তাদের ইলমের দ্বারা আল্লাহর পরিবর্তে বান্দার সন্তুষ্টি কামনা করে কিংবা আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিজেদের প্রবৃত্তিকেই ইলাহ্ ও উপাস্য হিসাবে গ্রহণ করে। এই শ্রেণির আলিমদের দ্বারা সমাজে সবচেয়ে বেশি ফিতনা বিস্তার লাভ করে এবং বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে। অসংখ্য মানুষ তাদের দ্বারা বিভ্রান্ত হয়। ইলমের কারণে জনসাধারণ তাদের ওপর আস্থা রাখে, আর তারা এই আস্থার গলদ ব্যবহার করে তাদেরকে বিপথে পরিচালিত করে। সুনানুদ্ দারিমিতে দুর্বল সনদে বর্ণিত হয়েছে, “এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ –কে নিকৃষ্ট সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করল। তখন রাসুলুল্লাহ তাকে বললেন, “তোমরা আমাকে নিকৃষ্ট সম্পর্কে জিজ্ঞাসা কোরো না। আমাকে উৎকৃষ্ট সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করো।” তিনি তিন বার এ কথা বললেন। এরপর বললেন, “জেনে রেখো, সবচেয়ে নিকৃষ্ট হলো তারা, যারা আলিমদের মধ্যে নিকৃষ্ট আর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট হলো তারা, যারা আলিমদের মধ্যে উৎকৃষ্ট।” আলি ইবনু আবি তালিব থেকে বর্ণিত হয়েছে, “অচিরেই মানবজাতির ওপর এমন এক কালের আবির্ভাব ঘটবে, যখন ইসলামের কিছুই বাকি থাকবে না—শুধু তার নাম ছাড়া। কুরআনের কিছুই বাকি থাকবে না—শুধু তার নকশা ছাড়া। তাদের মসজিদগুলো হবে জীবন্ত; কিন্তু তা হবে একেবারে হিদায়াতশূন্য। তাদের আলিমরা হবে আকাশের নিচে সবচেয়ে নিকৃষ্ট শ্রেণি। তাদের থেকেই ফিতনার উদ্ভব ঘটবে আর তাদের মাঝেই ফিতনার প্রত্যাবর্তন হবে।” উমর বলেন, “তুমি কি জানো, কোন জিনিস ইসলামকে ধ্বংস করে? ইসলামকে ধ্বংস করে আলিমের বিচ্যুতি, আল্লাহর কিতাব নিয়ে মুনাফিকের বিবাদ এবং পথভ্রষ্ট নেতাদের ফায়সালা।” শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু সালেহ আল-উসায়মিন অত্যন্ত সুন্দর বলেছেন, “প্রত্যেক আলিমই নির্ভরযোগ্য নয়। আলিম-উলামা সর্বমোট তিন শ্রেণির—উলামায়ে মিল্লাহ (মিল্লাতের আলিম), উলামায়ে দাওলাহ (রাষ্ট্রের আলিম), উলামায়ে উম্মাহ (জাতির আলিম)। উলামায়ে মিল্লাহ (আল্লাহ আমাদের সকলকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করে দিন) তাদের বলা হয়, যারা মিল্লাতে ইসলাম এবং আল্লাহ ও তার রাসুল এর বিধানসমূহকে আঁকড়ে ধরে, এ ছাড়া অন্য কাউকে মোটেও পরোয়া করে না—সে যে-ই হোক না কেন। উলামায়ে দাওলাহ সর্বদা শাসকের মর্জির প্রতি লক্ষ রাখে, তারা প্রবৃত্তিতাড়িত হয়ে বিধিবিধান উদ্গিরণ করে, তারা সার্বিক চেষ্টা করে নুসুসের ঘাড় ধরে তাকে তার প্রয়োগক্ষেত্র থেকে সরিয়ে অন্যদিকে ফেরাতে, যাতে তা সে সকল শাসকবর্গের খেয়ালখুশির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। এরাই হলো চরম ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রীয় উলামা। আর উলামায়ে উম্মাহ মানুষের ঝোঁক-প্রবণতার দিকে লক্ষ রাখে। যদি মানুষেরা কোনো জিনিসের বৈধতার প্রতি প্রলুব্ধ হয়ে পড়ে, তা হলে তারা সেটাকে হালাল ঘোষণা করে। আর যদি তারা কোনো জিনিসের নিষিদ্ধতার পক্ষে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে, তা হলে তারা সেটাকে হারাম বলে অভিহিত করে। তারা নুসুসকে সেদিকে ফেরায়, যা মানুষের খেয়ালখুশির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়।” বক্ষ্যমাণ গ্রন্থটি ইমাম জালালুদ্দীন আব্দুর রহমান সুয়ুতি (৮৪৯-৯১১ হিজরি) রচিত ما رواه الأساطين فى عدم المجيء إلى السلاطين এর বাংলায়ন। আলোচ্য কিতাবে ইমাম সুয়ুতি শাসকগোষ্ঠীর দরবারে যাতায়াতের ব্যাপারে হাদিসের আলোকে নববি চিন্তাধারা এবং আসারের আলোকে সালাফের দৃষ্টিভঙ্গি এবং তাদের কর্মপন্থা সুন্দরভাবে চিত্রিত করেছেন। বইটির প্রতিটি পাতায় ফুটে উঠেছে অনেক অজানা তথ্য-উপাত্ত। সালাফের গ্রন্থাদির সঙ্গে যারা পরিচিত—তাদের জন্য এই গ্রন্থটি অবশ্যই সুখপাঠ্য হবে বলে আশা করি। ওপরে সৎ আলিম এবং অসৎ আলিমের কথা উল্লিখিত হয়েছে। উভয় শ্রেণির আলিমদের সাথে সাধারণ জনগণকে পরিচিত করার জন্যই আমাদের এই উদ্যোগ। সমকালীন প্রেক্ষাপটে যেহেতু সারা পৃথিবী দরবারি আলিমে ছেয়ে গেছে, যাদের সুকৌশলে বিছানো ফাঁদে পা দিয়ে হাজারো মানুষ অবচেতনে অহর্নিশ বিভ্রান্ত হচ্ছে। তা ছাড়া মিডিয়ার বদৌলতে এসব আলিমদেরই এখন রাজত্ব চলছে সর্বত্র। পরিস্থিতি এ পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, যারাই শাসকের পদলেহন করবে, তারা নিরাপত্তার সঙ্গে প্রচুর অর্থবিত্তের মাঝে জীবনধারণ করে পৃথিবীর বুকে বাঁচতে পারবে। আর যারা সত্য প্রকাশে অকুতোভয় হওয়ার পরিচয় দেবে, তাদের কপালেই নেমে আসবে দুর্ভোগ। আখের কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠের একচিলতে জায়গায় তাদের ঠাঁই মিলবে। আলোচ্য গ্রন্থটি পড়লে যেকোনো পাঠকের সামনে এ কথা ইন শা আল্লাহ দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, সালাফেসালেহিন শাসকদের কাছে যাতায়াতকেই মন্দ নজরে দেখতেন। আলিমদের জন্য বিষয়টি তো আরও গুরুতর। শাসক যদি জালিম হয়, তা হলে তাদের কাছে যাতায়াত জুলমের পথে সহায়তার নামান্তরএবং অত্যন্ত গর্হিত ও মন্দ কাজ। আর শাসক যদি জালিম নাও হয়ে থাকে, তবুও তাদের কাছে যাতায়াত ফিতনার কারণ এবং অনেকের জন্য রীতিমতো নিন্দনীয়। এখানে অবশ্য একটি কথা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য, ইমাম সুয়ুতি বক্ষ্যমাণ গ্রন্থে যে সকল শাসকদের প্রসঙ্গ টেনেছেন, তারা সকলেই ছিল মুসলিম শাসক। ব্যক্তিগত পর্যায়ে তাদের জীবনাচার অতি মন্দ হলেও তারা আল্লাহর হাকিমিয়্যাত (বিধানদাতা হওয়ার বিশেষণ)-কে অস্বীকার করত না, শরিয়াহর মাঝে বিকৃতি সাধন করত না, আইনপ্রণয়নের ক্ষেত্রেও তারা শরিয়াহর সার্বিক নির্দেশনা মেনে চলত, আইনপ্রয়োগে শৈথিল্য থাকলেও কুরআন-সুন্নাহ নির্দেশিত আইনকে বুড়ো আঙুল প্রদর্শন করত না। এমনকি তাদের অসংখ্যজন দ্বীনের আলিম ছিল, শরিয়াহ সম্পর্কে যাদের পর্যাপ্ত জ্ঞান এবং বিস্তর জানাশোনা ছিল। তারা ব্যক্তিগত জীবনে পাপী ছিল ঠিক, কিন্তু তাদের পাপ ইসলামের সীমা অতিক্রম করেনি এবং তারা কুফর ও রিদ্দাহ্র চৌহদ্দিতে প্রবেশ করেনি। জালিম ও ফাসিক শাসকের সাথেই যখন সালাফেসালেহিনের কর্মপন্থা এমন ছিল, তা হলে সে সকল শাসকের ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে, যারা আল্লাহর হাকিমিয়্যাতকে অস্বীকার করেছে। ইসলামি শরিয়াহকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছে। কুফফার গোষ্ঠীর ক্রীড়নক হয়ে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে ভয়াবহ ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। ইসলামি শাসনব্যবস্থাকে পৃথিবী থেকে উৎখাত করে মানবরচিত শাসনব্যবস্থা প্রণয়ন করেছে। ইসলামি আইনকানুন বিধিবিধান ও নীতিমালাকে রহিত করে কুরআন-সুন্নাহর সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক বিধান-সংবিধান অনুযায়ী শাসন ও বিচারকার্য পরিচালনা করেছে। যারা শরিয়াহ প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রামে নেমেছে—তাদের সমাজ থেকে উৎখাত করার জন্য যারপরনাই চেষ্টা করেছে এবং যাদের বেশি ঝুঁকির কারণ মনে করেছে—তাদের অস্তিত্বই পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে কিংবা তাদের জীবনকে চূড়ান্ত পর্যায়ের অতিষ্ঠ করে ছেড়েছে? নিশ্চয়ই যারা এমন অপরাধে লিপ্ত—তারা এবং তাদের মদদদাতা ও সমর্থকরা যে ইসলামের সীমানা অতিক্রম করে কুফরের সীমানায় পা রেখেছে এবং চেতনে কিংবা অবচেতনে রিদ্দাহ্য় লিপ্ত হয়েছে—এ ব্যাপারে মুরজিয়াপন্থী ছাড়া প্রকৃত আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ্র অনুসারী হওয়ার দাবিদার কোনো সচেতন মুসলিমের দ্বিমত থাকতে পারে না। কারণ, তাদের কুফর এবং রিদ্দাহ্র বিষয়টা কোনো খারেজি মতবাদ নয়; বরং এটাই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ্র সর্বস্বীকৃত মত। স্বতন্ত্র কোনো গ্রন্থে এ বিষয়ে আমরা সবিস্তারে আলোচনা করব ইন শা আল্লাহ। ইমাম সুয়ুতি বক্ষ্যমাণ গ্রন্থে যে সকল বর্ণনা ও আলোচনা এনেছেন, তা জালিম কিংবা ফাসিক মুসলিম শাসকের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ। কাফির কিংবা মুরতাদ শাসকের ব্যাপারে এ সকল আলোচনাকে প্রয়োগ করলে নিঃসন্দেহে তা হবে বিরাট জুলম, যা থেকে লেখক, অনুবাদক ও প্রকাশক সকলেই দায়মুক্ত। কাফির-মুরতাদের সঙ্গে আচরণের ব্যাপারে ইসলামি শরিয়াহ আলাদা বিধান ও নীতিমালা দিয়েছে এবং মুসলিমদের জন্য তা মান্য করাকে অপরিহার্য করেছে। তাগুত এবং তাগুতের দোসরদের সাথে হৃদ্যতা কিংবা সম্প্রীতির বন্ধন গড়ার কোনোই অবকাশ নেই। হিকমাহ্র ধোঁয়া তুলেও কেউ যদি এমন করে, তা হলে তার ব্যাপারে এ কথা বললে বোধহয় অত্যুক্তি হবে না যে, নিজ হাতে সে ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি এবং নববি ভাবধারাকে জলাঞ্জলি দিয়েছে, ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আকিদা ‘আলওয়ালা ওয়াল বারা’র নীতিকে সে স্বেচ্ছায় লঙ্ঘন করেছে কিংবা চেতনে বা অবচেতনে গলা থেকে ইসলামের রশিকে খুলে ফেলেছে। আদতে এরা কুরআনের কিছু অংশের প্রতি ইমান এনেছে আর কিছু অংশকে অস্বীকার করেছে। তারা রহমান আল্লাহকে ইলাহ হিসাবে গ্রহণ করেনি; বরং তারা নিজেদের নফসকেই ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে। ‘আদ-দ্বীনুল হানিফ’ এবং ‘মিল্লাতে ইবরাহিম’কে বিকিয়ে তারা দুনিয়া ও আখিরাত—উভয় জগতে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইমাম সুয়ুতি এর বক্ষ্যমাণ গ্রন্থে যেহেতু শুধু স্বার্থান্বেষী শাসকপক্ষীয় আলিমদের চিত্র উঠে এসেছে, তাই এর অব্যবহিত পরেই ইন শা আল্লাহ আমরা ইমাম আবু বকর আজুর্রি (মৃত্যু : ৩৬০ হিজরি) রচিত আখলাকুল উলামা (উলামাচরিত) গ্রন্থটি পাঠকদের করকমলে তুলে দেওয়ার প্রয়াস পাব; যাতে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয় দিকই পাঠকদের সামনে আসে এবং সচেতন পাঠকরা যেন তাগুতের দোসর কিংবা স্বার্থান্বেষী অসৎ দরবারি আলিমদের ফিতনা থেকে নিজেদের দ্বীন এবং ইমানকে সুরক্ষিত রাখতে পারে; পাশাপাশি হাক্কানি রাব্বানি সৎ আলিমদের পরিচয় জেনে তাদের সংস্পর্শে গিয়ে নিজেদের জীবনকে দীপ্ত ও আলোকিত করতে পারে। আর সর্বাবস্থায় তালিবুল ইলম পাঠকরা যেন আগামীর যোগ্য কাণ্ডারিরূপে গড়ে উঠতে পারে এবং এখন থেকেই নফস ও শয়তানের ধোঁকা থেকে নিরাপদ থাকার প্রশিক্ষণ হাতে-কলমে লাভ করে তার যথাযথ প্রয়োগ করতে পারে। আল্লাহ বলেন, “তোমরা আলিমদের জিজ্ঞাসা করো, যদি তোমরা কোনো ব্যাপারে অবগত না থাকো।”বক্ষ্যমাণ গ্রন্থের অনুবাদের ক্ষেত্রে আমরা যে-সকল নুসখার ওপর নির্ভর করেছি— দারুস সাহাবাহ লিততুরাস; পাণ্ডুলিপি, আলমাকতাবাতুল আযহারিয়্যাহ; পোর্টেবল ডকুমেন্ট ফরম্যাট (PDF), মিম্বারুত তাওহিদ ওয়াল জিহাদ; নুসখা, আলমাকাতাবুশ শামিলাহ। ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ুতি রচিত বক্ষ্যমাণ গ্রন্থে যে-সকল জাল, ভিত্তিহীন এবং অপ্রমাণিত বর্ণা্লিিত হয়েছিলো, আমরা সবশ্রেণির পাঠকের কথা বিবেচনা করে অনুবাদ থেকে সে-সকল বর্ণনা বাদ দিয়ে দিয়েছি। যা-কিছু হাদিস-বিশারদগণের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ এবং যার বর্ণনাসূত্র মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টিতে প্রমাণিত, আমরা এ গ্রন্থে শুধু তা-ই উল্লেখ করেছি। মহান আল্লাহ এর কাছে প্রত্যাশা, তিনি যেনো এই গ্রন্থটিকে কবুল করে নেন, এর প্রকাশনার সঙ্গে যারা যেভাবে জড়িত—সকলকে উত্তম বিনিময় দান করেন এবং তিনি এর দ্বারা সকল শ্রেণির পাঠককে উপকৃত করেন। আমিন।
জন্ম ১৫ মে ১৯৫১ , ঢাকায় | বাবা মরহুম মোহাম্মদ আব্দুল লতিফ , মা মরহুম খুরশীদা লতিফ | ষাটের দশকের মাঝামাঝি কামরুন্নেসা সরকারি বিদ্যালয়ে পড়ার সময় লেখালেখির সূচনা | ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ‘ নবাবগঞ্জ সাময়িকী ‘ নামে একটি পত্রিকায় | কবিতাটির নাম ‘ আগামি দিনের নাগরিক ‘ | প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ কালো ময়ূরের ডাক ‘ প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে | অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে এই ছুরিই আরশি ( ১৯৮৯ ) , সেগুন মেহগনি ও অন্যান্য কবিতা ( ১৯৯৩ ) , এই আমি নিজস্ব আমি ( ২০০২ ) , জলের আরশিতে নির্নিমেষ চেয়ে থাকা একটি হিজল গাছ ( ২০১৭ ) | একটি প্রবন্ধগ্রন্থ __ প্রসঙ্গ : সাহিত্য ও জীবন (২০০৪ ) | ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ ১৯৭৪ -এ | ঢাকার লালমাটিয়া মহিলা মহাবিদ্যালয়ে ১৯৭৭ - এ শিক্ষকতা জীবন শুরু | ২০১১ - এ অবসর গ্রহণ বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে |