মুখবন্ধ আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জন্মলগ্ন থেকেই শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করছে। ১৯৯০ সালে শিশু অধিকার ইউনিট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শ্রমজীবী শিশুদের জন্য কাজ শুরু করেন খুরশীদ এরফান আহমেদ। ১৯৮৬ সালে আসক প্রতিষ্ঠার পেছনে যেসব নিবেদিতপ্রাণ মানুষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন, খুরশীদ এরফান আহমেদ তাঁদের একজন। তিনি আইনজীবী ছিলেন না, ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ। যুক্ত ছিলেন ব্রিটিশ কাউন্সিলের সঙ্গে। শ্রমজীবী শিশুদের নিয়ে কাজ শুরু করার আগে খুরশীদ এরফান আহমেদ ‘Where children are adult’ নামে একটি গবেষণা পরিচালনা করেন। এই গবেষণার মাধ্যমে খতিয়ে দেখা হয় একটি শিশু স্কুলে নিয়মিত যাচ্ছে কি না। স্কুলে পড়তে আগ্রহী কি না। যদি কোনাে শিশু স্কুলে না যায়, তাহলে তার ঝরে পড়ার কারণ কী। শিশুর লেখাপড়ার ব্যাপারে অভিভাবক, নিয়ােগকর্তা বা শিশুর আগ্রহ আছে কি না ইত্যাদি। যদিও এসব তথ্য স্বল্পসংখ্যক শিশুর কাছ থেকে নেয়া হয়েছে, তথাপি এগুলাের ভিত্তিতে তাদের পরিবারের ধরন, বড়দের ভূমিকায় শিশুদের অবতীর্ণ হওয়া সম্পর্কে জানা যায়। শৈশবেই পরিবারের জন্য অর্থ উপাজর্নের দায়ভার কাঁধে নিতে হচ্ছে বলে আমাদের দেশের লাখ লাখ শিশু হারিয়ে ফেলছে তার শৈশব। দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য যদি এত প্রকট না হতাে, আইন এবং শিক্ষাব্যবস্থা যদি শিশুর সুরক্ষা এবং স্বাভাবিক বিকাশ নিশ্চিত করতে পারত, তাহলে এসব শিশুর জীবন অন্য রকম হতাে। তারা বেড়ে উঠতে পারত শৈশবের আনন্দ উপভােগ করার মধ্য দিয়ে। এই উপলব্ধি থেকেই শ্রমজীবী শিশুদের জন্য কাজ শুরু করেন খুরশীদ এরফান আহমেদ। এ ক্ষেত্রে তাঁর শিক্ষাক্ষেত্রের অভিজ্ঞতাও কাজে লাগাতে চাইলেন। শুরুতে শ্রমজীবী শিশুর স্বাভাবিক শৈশব ফিরিয়ে দেয়ার জন্য সরাসরি সেবামূলক কিছু কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়, যার নাম দেয়া হয়েছে HELP অর্থাৎ হেলথ, এডুকেশন, লিগ্যাল প্রােটেকশন। এই কার্যক্রম পরিচালনার জন্য খুরশীদ এরফান আহমেদ ‘ডুপইন সেন্টার’ মডেল চালু করেন। ড্রপইন সেন্টার হচ্ছে শ্রমজীবী শিশুদের জন্য এমন একটি কেন্দ্র, যেখানে তারা তাদের কাজের ফাঁকে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত যেকোনাে সময় আসতে পারবে। এই ড্রপ-ইন সেন্টার পরিচালিত শিক্ষা কার্যক্রমটির নাম দেয়া হয় যখন তখন শিক্ষা'। অর্থাৎ শ্রমজীবী শিশুরা কাজের ফাঁকে যেন শিক্ষা লাভের সুযােগ পায়, সে উদ্দেশ্যই এর শিক্ষা কারিকুলাম তৈরি করা হয়। শিক্ষার পাশাপাশি আনন্দ, বিনােদন এবং বিশ্রামের এক মিলনকেন্দ্র হিসেবে দ্রুতই শ্রমজীবী শিশুদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই যখন-তখন শিক্ষা। উল্লেখ্য যে, খুরশীদ এরফান মুখবন্ধ xi আহমেদেরই প্রকল্প প্রস্তাবনায় বাংলাদেশ সরকার ও জাতিসংঘ উন্নয়ন প্রকল্প (ইউএনডিপি) যৌথভাবে ড্রপইন সেন্টার ‘মডেল’ চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়, যা ১৯৯৯ 5716 Appropriate Resources for Improving Street Children's Environment (ARISE) project নামে পরিচিতি লাভ করে। শুরুতে এই প্রজেক্টের লক্ষ্যমাত্রা ছিল প্রায় ২ লাখ ১৫ হাজার সুবিধাবঞ্চিত পথশিশু। বর্তমানে বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে সমস্ত বাংলাদেশে ড্রপইন সেন্টার মডেলটি পরিচালিত হচ্ছে। ১৯৯০ থেকে ২০১৭, এই ২৭ বছরের পরিক্রমা সামনে রেখে আসক থেকে প্রকাশিত হচ্ছে বাংলাদেশের শিশু ও শিশুর অধিকার' নামের একটি প্রকাশনা। তাতে শ্রমজীবী শিশুই যে বিশেষভাবে গুরুত্ব পাবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই সুবিধাবঞ্চিত ও নানাভাবে নিগৃহীত শিশুরা দেশের জনসংখ্যার এক বিরাট অংশ। ২০১৩ সালের জাতীয় শিশুশ্রম জরিপে দেখা যায়, দেশের প্রায় ৩৪ লাখ ৫০ হাজার শিশু বিভিন্ন শ্রম খাতে কাজ করছে এবং ১৫ থেকে ১৭ বছর বয়সি প্রায় ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়ােজিত আছে। ২০১২ সালের ৩৮টি চিহ্নিত খাতের মধ্যে এখন পর্যন্ত কেবল দুটি খাতই শিশুশ্রম মুক্ত হয়েছে। এগুলাে হচ্ছে গার্মেন্টস আর চিংড়িশিল্প। অন্যদিকে পরিবহণশিল্পসহ অন্যান্য বিভিন্ন খাতে এখনাে উচ্চমাত্রায় শিশুশ্রম বিরাজমান। এসব খাতে অনেক শিশুই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়ােজিত। আমরা যদি শিশু অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার দিকে তাকাই, তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অস্বাভাবিকভাবে। হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, বখাটেদের উৎপাত, পাচার, অস্বাভাবিক মৃত্যু, অ্যাসিড নিক্ষেপসহ প্রতিনিয়ত শিশু অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। গত কয়েক বছরে শিশু হত্যার কয়েকটি লােমহর্ষক ঘটনা দেশের মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। শিশুর সঙ্গে খেলা করা নিয়ে শিশু রত্নাকে, যৌতুকের লােভে ডনকে, ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায়ের জন্য শিহাবকে হত্যা করা হয়। বাবার কোলে নিহত হয়েছে শিশু নওশিন। শরীরে বাতাস প্রবেশ করিয়ে হত্যা করা হয়েছিল খুলনার শিশু রাকিব, চুরির অপরাধে জনসম্মুখে হত্যা করা হয়েছিল সিলেটের শিশু রাজনকে। এসব নজিরবিহীন হত্যার ধরন ও হত্যাকাণ্ড নিরাপত্তাহীনতায় ফেলেছে অভিভাবকদের। প্রশ্নবিদ্ধ করছে জাগ্রত বিবেককে। আদালতের বেশ কয়েকটি রায়ে মানুষ কিছুটা আশ্বস্ত হলেও সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। ‘বাংলাদেশের শিশু ও শিশুর অধিকার’ বইয়ে থাকছে তিনটি অধ্যায়। প্রথম অধ্যায়ের শিরােনাম ‘আইন ও নীতিমালা'। এতে আছে শিশু আইন ২০১৩ নিয়ে একটি বিশ্লেষণমূলক রচনা, কয়েকটি আলােচিত মামলার রায়, শিশু-সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক আইন এবং প্রস্তাবিত বাংলাদেশ শিশু কমিশন নিয়ে লেখা একটি গুরুত্বপূর্ণ নিবদ্ধ। বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়ের শিরােনাম ‘শিশুরা কেমন আছে'। এ অধ্যায়ের উনিশটি লেখার মাধ্যমে কর্মজীবী শিশু, কন্যাশিশু, আদিবাসী শিশু, সুইপার শিশুদের অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে। আর তৃতীয় অধ্যায়ে রয়েছে আসক-এর চাইল্ড রাইটস ইউনিটের কর্মজীবী শিশুদের নিয়ে বিচিত্র সব কাজের খবর। উল্লেখ্য যে, বইয়ের সব কটি xii বাংলাদেশের শিশু ও শিশুর অধিকার অধ্যায়ে নতুন লেখাপত্রের পাশাপাশি পূর্বপ্রকাশিত বাংলা ও ইংরেজি লেখা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পূর্বপ্রকাশিত লেখাগুলাে আসক-এর শিশুসংক্রান্ত কাজের দীর্ঘ পথ পরিক্রমার নানা বাঁকে শিশু-সম্পর্কিত সচেতনতা বৃদ্ধি, প্রচলিত আইনের সংস্কার, রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে রচিত হয়েছিল, যা আজও প্রাসঙ্গিক। বইটি দ্বিভাষিক হওয়ার পেছনেও এই একই কারণ। তা ছাড়া এতে করে পাঠক ইংরেজি ভাষায় রচিত মূল লেখাটির আস্বাদ নেয়ার সুযােগ পাবেন। উল্লেখ্য যে, আসক-এর প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালক প্রয়াত সালমা সােবহানের দুটি রচনার বাংলা অনুবাদসহ ইংরেজি মূল রচনা বইয়ের প্রথম দুটি অধ্যায়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ বইয়ের ইংরেজি লেখা নির্বাচন, সম্পাদনাসহ নানা পরামর্শ দিয়ে যিনি সহায়তা করেছেন, তিনি আসক-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হামিদা হােসেন। আমি তার প্রতি সবিশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই। আসক-এর শিশু অধিকার ইউনিটের মাে. মকছুদ মালেক ও রাশেদা আক্তার নানা তথ্য, লেখা, ছবি সরবরাহ করে বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। লেখাপত্রের আইনগত সম্পাদনা করেছেন আসক-এর আইনজীবী নীনা গােস্বামী। কমিউনিকেশন অ্যান্ড পাবলিকেশন ইউনিটের শাহীন আখতার ‘বাংলাদেশের শিশু ও শিশুর অধিকার’ বইয়ের পরিকল্পনা ও সম্পাদনা করেছেন। উক্ত ইউনিটের কানিজ খাদিজা সুরভী বইটি প্রকাশের ক্ষেত্রে যােগাযােগসহ আনুষঙ্গিক কাজ করেছেন। বইয়ের পেজমেকাপ করেছেন অনিল মণ্ডল। প্রচ্ছদ ডিজাইন করেছেন মনন মাের্শেদ। তাঁদের সবাইকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। ধন্যবাদ জানাই এ বইয়ের সব লেখককে। সবশেষে বলতে চাই, যার হাত দিয়ে আসক-এর শিশু অধিকার ইউনিটের প্রতিষ্ঠা এবং যার মেধা ও কাজের আংশিক ফসল এ বই, তিনি খুরশীদ এরফান আহমেদ। আমি খুরশীদ এরফান আহমেদকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই।
শীপা হাফিজা নির্বাহী পরিচালক আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)