প্রথম ফ্ল্যাপ: উইলিয়াম ফকনারের অনন্য বর্ণনাকৌশলের বৈশিষ্ট্যÑ প্রথমত, একই ঘটনাকে বিচিত্র দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা। দ্বিতীয়ত, চরিত্রের অন্তর্গত মানসিক পরিস্থিতিকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে চরিত্রের কণ্ঠে তুলে আনাÑ এই দুইয়ের সফল প্রয়োগের সবচেয়ে যোগ্য উদাহরণ, ‘মৃত্যুর প্রতীক্ষায় আমি’ উপন্যাসটি। বানড্রেন পরিবারে অ্যাডির মৃতদেহ মৃতের শেষ ইচ্ছানুসারে জেফারসনে নিয়ে গিয়ে কবর দেয়াকে ঘিরে কাহিনির অবতারণা। যাত্রাপথে নানান দুর্যোগের উপস্থিতি পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের সুপ্ত মানসিক টানাপোড়েনকে উস্কে দেয়। চরিত্ররা যার যার বয়ানে নিজের এবং অন্যদের কথা বলতে থাকেন। এমনকি মৃত অ্যাডি বানড্রেনও তার বক্তব্য উপস্থাপনে পিছিয়ে থাকেন না। এভাবে, ভিন্ন বয়সের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন পনেরো চরিত্রের বক্তব্য আর না-বলা কথার মধ্যে দিয়ে উপন্যাসের কাহিনি এগোয়। তাই এখানে পনেরোটি ভিন্ন কণ্ঠ শুনতে পাওয়া যায়, দেখা মেলে পনেরো জাতের গদ্যের। দুজন মানুষ কখনো ভিন্ন কায়দায় একই দৃশ্যের বর্ণনা করেন, অথচ পুনরাবৃত্তি কোথাও বিরক্তি জাগায় না; বরং পাঠকের মনে দুজনের মনমতো বর্ণনা মিলে এক নতুন অনুভূতির উদ্রেক করে। ফকনারের কল্পকাহিনিতে প্রতিষ্ঠা পাওয়া মিসিসিপির কল্পিত ‘ইয়োকনাপাথাওফা’ স্থানটি এই উপন্যাসেই প্রথম পাঠকের সামনে আসে। পরবর্তীকালে একই পটভূমিতে ফকনারের হাতে রচিত হয় আরো সাতটি কালজয়ী উপন্যাস। কল্পিত পটভূমির সফলতম প্রয়োগের ক্ষেত্রে ‘মৃত্যুর প্রতীক্ষায় আমি’ উপন্যাসটি উল্লেখযোগ্য। ১৯৩০ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাসটি বরাবর বিশ শতকের প্রধান একশ উপন্যাসের মধ্যে স্থান পেয়ে এসেছে। দক্ষিণাংশে জন্ম নেয়া বিখ্যাত সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনিই সেরা . . . উনিশ শতক পেরিয়ে গেলেও দক্ষিণাঞ্চলে যে সামাজিক আর নৈতিক সমস্যা বিদ্যমান ছিল, একের পর এক উপন্যাস আর ছোটোগল্পের মধ্য দিয়ে ফকনার সেসবের সঙ্গে লড়ে গেছেন। দক্ষিণের পরিবেশকে মাথায় রেখে ফকনার বরাবর সেখানকার মানুষের স্বরূপ উদঘাটন করতে চেয়েছেন। আর এ কারণেই মানুষের সত্যিকারের প্রতিকৃতি খোঁজার জন্য বারবার ফিরে তাকাতে হয় তার রচনার দিকে, যা আমাদের চিরায়ত সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। -রাল্ফ এলিসন ফকনারের মতো নিজের রচনায় হৃদয় এবং আত্মা অকাতরে বিলিয়ে দিতে অন্য কেউ পারেননি। পাঠক হিসেবে কেউ যদি সেই আত্মার খোঁজ করতে চায় তবে নিশ্চিতভাবে দেখবে তার রচনায় বরাবর তা জ্বলজ্বল করছে। -ইউডোরা ওয়েল্টি বুদ্ধিদীপ্ত এবং পাঠককে আটকে রাখার উপযুক্ত রচনা যা শেষ পাতা পর্যন্ত পড়তে বাধ্য করবে। -স্পেকটেটর
উইলিয়াম ফকনার ১৮৯৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের মিসিসিপির নিউ অ্যালবানিতে জন্মগ্রহণ করেন। আমেরিকান লেখক ফকনার একাধারে নাটক, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও চিত্রনাট্য লেখায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলের কাহিনি ফকনারের কলমেই সর্বোচ্চ মর্যাদা পেয়েছে। সাউদার্ন গোথিক রচনা কৌশল এবং মিথের ব্যবহারসহ বর্ণনার ক্ষেত্রে মনোলগ বা স্ট্রিম অব কনশাসনেস পদ্ধতির অনুসরণ তার রচনার বিশেষ দিক। ১৯১৯ সাল থেকে তার রচনা নিয়মিত প্রকাশ পেতে শুরু করে। আমেরিকান সাহিত্যে ছোটোগল্পের জনপ্রিয় বইয়ের মধ্যে ফকনারের ‘আ রোজ ফর এমিলি’ বিপুল সাড়া জাগানো। কৈশোরে কবিতা দিয়ে হাতেখড়ি হয়েছিল তার। ১৯২৫ সালে প্রথম উপন্যাস রচনা করতে শুরু করেন। ‘মৃত্যুর প্রতীক্ষায় আমি’ উইলিয়াম ফকনারের পঞ্চম উপন্যাস। দ্য সাউন্ড অ্যান্ড দ্য ফিউরি (১৯২৯), লাইট ইন অগাস্ট (১৯৩২), অ্যাবসালোম অ্যাবসালোম (১৯৩৬) তার অন্যান্য কালজয়ী উপন্যাস। আ ফেইবল (১৯৫৪) এবং শেষ উপন্যাস দ্য রেইভার্স (১৯৬২)-এর জন্য তিনি দু’বার পুলিৎজার পুরস্কার অর্জন করেন। ১৯৪৯ সালে উইলিয়াম ফকনার নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। পাঁচ বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে উইলিয়াম ফকনার অক্সফোর্ডে চলে যান। তারপর থেকে জীবনের বাকি সময়টা সেখানেই কাটে তার। মা আর নানির তত্ত্বাবধানে ফকনার স্কুলের পড়াশোনা শুরুর আগে দিনের পর দিন প্রকৃতির সঙ্গে পরিচিত হন। চার্লস ডিকেন্স আর গ্রিমসের রূপকথা পড়ে তার শৈশব কাটে। বয়োজ্যোষ্ঠদের মুখে প্রাচীন কল্পকাহিনি আর ইতিহাসের বর্ণনা শুনে শুনে তিনি বড়ো হন। পরিবারে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার চেয়ে জীবনবোধ তৈরিতে বেশি গুরুত্ব দেয়া হতো। একসময় ফকনার নিজেও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার উপরে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েন। একাদশ শ্রেণিতে দু’বার থাকার পরে তিনি আর পড়াশোনা করেননি। তবে ১৯১৯ সালে ইউনিভার্সিটি অব মিসিসিপিতে আরেকবার শুরু করলেও ১৯২০ সাল নাগাদ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় চিরকালের মতো ইস্তফা দেন। ১৯৬২ সালের ১৭ জুন তিনি ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে মারাত্মকভাবে আহত হন; আঘাতের ফলে থ্রম্বোসিস রোগে আক্রান্ত হন। মিসিসিপির বাইহালিয়ায় ১৯৬২ সালের ৬ জুলাই ৬৪ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।