"আমার লাদাখ যাত্রা" বইটির সম্পর্কে কিছু কথা: রাহুল সাংকৃত্যায়ন ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও অসাধারণ প্রতিভাধর এক ব্যক্তি। কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই যে ব্যক্তি অগাধ পাণ্ডিত্য অর্জন করতে পারেন তাকে মেধাবী আর অসামান্য প্রতিভার অধিকারী ছাড়া আর কিই বা বর্ণনা করা যায়। কিন্তু এই পণ্ডিত ব্যক্তি আর দশজন পণ্ডিত বা বিদ্বান ব্যক্তি থেকে সম্পূর্ণরূপে পৃথক ছিলেন। সাধারণত পণ্ডিত ব্যক্তিরা নিঝঞাট জীবন পছন্দ করেন। আবার অনেকে বিলাসী জীবন বেছে নেন। কিন্তু রাহুল সাংকৃত্যায়ন তার পরিবর্তে এক কঠিন ঝুঁকিপূর্ণ জীবন বেছে নিয়েছিলেন। জীবনের শুরু থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি একটার পর একটা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন। সেই সঙ্গে গরীব-মেহনতী মানুষের প্রতি ছিল তার অগাধ বিশ্বাস আর ভালবাসা। এই ভালবাসা তাকে নিয়ে যায় সরাসরি রাজনীতির ময়দানে। তিনি রাজনীতিতে যােগ দেন ও নেতৃত্ব দেন। কৃষক আন্দোলনের। এখানেই তিনি থেমে থাকেন নি। তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়ে সমাজ বদলের সংগ্রামে শরীক হন। এজন্য তাকে কারা নির্যাতনও ভোগ করতে হয়। শুরুতেই বলেছি পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন। এই চ্যালেঞ্জ নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন ভারতবর্ষসহ বিশ্বের দুর্গম অঞ্চলে। তেমনি এক দুর্গম অঞ্চল ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন ‘আমার লাদাখ যাত্রা’য়। এখানে বলা দরকার যে, রাহুল সাংকৃত্যায়ন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যহীনভাবে স্রেফ ভ্রমণের জন্য লাদাখ গিয়েছিলেন তা মােটেই নয়। তিনি লাদাখ গিয়েছিলেন প্রাচীন বৌদ্ধ সাহিত্য, দর্শন ও বিচারশাস্ত্র সম্বন্ধীয় গ্রন্থের অনুসন্ধানে। দুর্গম পাহাড়, পর্বত, গিরিশৃঙ্গ পার হয়ে তার অনুসন্ধানী তৎপরতায় তিনি দু’মনেরও বেশি পুথিপত্র সংগ্রহ করেন। যা দেশ-জাতি ও বিশ্ববাসীর কাছে এক বিশাল সৌভাগ্যের বিষয়। কারণ গবেষকদের গবেষণার জন্য এত বেশি রসদ তিনি দিয়ে গেছেন যা রীতিমত এক বিস্ময়কর।
তাঁর জন্ম ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে সনাতন হিন্দু ভূমিহার ব্রাহ্মণ পরিবারে। জন্মস্থান উত্তর প্রদেশের আজমগড়ের একটি ছোট্ট গ্রাম। তাঁর আসল নাম ছিল কেদারনাথ পাণ্ডে। ছোটোবেলাতেই তিনি মাকে হারান। তাঁর পিতা গোবর্ধন পান্ডে ছিলেন একজন কৃষক। বাল্য কালে তিনি একটি গ্রাম্য পাঠশালায় ভর্তি হয়েছিলেন। আর এটিই ছিলো তাঁর জীবনে একমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। অষ্টম শ্রেণী অবধি অধ্যয়ন করেছিলেন। এখানে তিনি উর্দু ও সংস্কৃতের উপর প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। তিনি বহু ভাষায় শিক্ষা করেছিলেন যথা : হিন্দি, উর্দু, বাংলা, পালি, সংস্কৃত, আরবি, ফারসি, ইংরেজি, তিব্বতি ও রুশ।
পুরস্কার তালিকা পদ্মভূষণ (১৯৬৩) সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার (১৯৫৮)
ব্যক্তিগত জীবন জালিওয়ানওয়ালা বাগের হত্যাকান্ড (১৯১৯) তাঁকে একজন শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী কর্মীতে রূপান্তরিত করে। এ সময় ইংরেজ বিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে তাকে আটক করা হয় এবং তিন বছরের কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। এ সময়টিতে তিনি পবিত্র কুরআন শরীফ সংস্কৃতে অনুবাদ করেন। পালি ও সিংহল ভাষা শিখে তিনি মূল বৌদ্ধ গ্রন্থগুলো পড়া শুরু করেন। এ সময় তিনি বৌদ্ধ ধর্ম দ্বারা আকৃষ্ট হন এবং নিজ নাম পরিবর্তন করে রাখেন রাহুল (বুদ্ধের পুত্রের নামানুসারে) সাংকৃত্যায়ন (আত্তীকরণ করে যে)।, জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি বিহারে চলে যান এবং ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ-এর সাথে কাজ করা শুরু করেন। তিনি গান্ধিজীর আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন এবং এসময় তিনি গান্ধীজী প্রণীত কর্মসূচীতে যোগদান করেন। যদিও তাঁর কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ছিলো না, তবুও তার অসাধারণ পান্ডিত্যের জন্য রাশিয়ায় থাকাকালীন লেনিনগ্রাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে শিক্ষকতার অনুরোধ করা হয়। তিনি তা গ্রহণ করেছিলেন। ভারতে এসে তিনি ডঃ কমলা নামক একজন ভারতীয় নেপালি মহিলা কে বিয়ে করেন। তাদের দুই সন্তান হয়, কন্যা জয়া ও পুত্র জিৎ। পরে শ্রীলংকায় (তৎকালীন সিংহল) বিদ্যালঙ্কার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এখানে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে দার্জিলিংয়ে, ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দের ১৪ এপ্রিল তারিখে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।