উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের একটি অংশে, বিশেষ করে তার শেষের দিকে, নিউ ইয়র্ক শহরে একজন ডাক্তার বেশ ভালো পসার জমিয়েছিলেন। আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে বিশিষ্ট চিকিৎসকবৃন্দ বরাবরই যে শ্রদ্ধা পেয়ে এসেছেন, তার খুব সামান্য পরিমাণেই জুটেছিল তাঁর ভাগ্যে। ডাক্তারি পেশাটি আমেরিকায় চিরকালই সম্মানিত এবং এর সম্বন্ধে ‘উদার’ বিশেষণটি এদেশে যেমন সফল এবং সার্থকভাবে প্রযুক্ত হতে পেরেছে, তেমন আর কোনো দেশেই নয়। যে দেশে বা সমাজে প্রতিষ্ঠা পেতে হলে ভালো আয় করতে হয়, অথবা লোকের মনে বিশ্বাস জন্মাতে হয় যে ভালো আয় হচ্ছে, সে দেশে প্রতিষ্ঠা লাভের দুটি উপায় চমৎকারভাবে মিলিত হয়েছে চিকিৎসা বিদ্যায়। এ বিদ্যার আসল স্থান হচ্ছে বাস্তব কার্যকারিতার ক্ষেত্রে, যেটা যুক্তরাষ্ট্রে এর পক্ষে একটা মস্ত বড় কথা; তাছাড়া এতে রয়েছে বিজ্ঞানের আলোর পরশ—যে সমাজে জ্ঞান স্পৃহা আছে কিন্তু জ্ঞানার্জনের অবসর বা সুযোগ নেই, সেই সমাজে এই গুণটির বিশেষ আদর। ডাক্তার স্লোপারের খ্যাতি ছিল এই কারণেও, যে তাঁর চিকিৎসাশাস্ত্রের জ্ঞান এবং হাতেকলমে চিকিৎসা করার ক্ষমতা দুইই সমান ছিল; তিনি ছিলেন যাকে বলা যায় ‘বিদ্যান’ বা ‘পণ্ডিত’ ডাক্তার যদিও তাঁর চিকিৎসা বিধানে কোনোরকম ধোঁয়াটেপনা ছিল না, তিনি সব সময় কোনো-না-কোনো ওষুধে খেতে দিতেন। প্রত্যেকটি খুঁটিনাটির দিকে তাঁর তীক্ষ্ণ নজর ছিল, কিন্তু তাই বলে তিনি তত্ত্বের বোঝা চাপিয়ে কাউকে বিরক্ত করতেন না; রোগীকে যতটুকু বুঝিয়ে বলা দরকার, কখনো কখনো তিনি তাঁকে তার চাইতে বেশি খুঁটিয়ে বোঝাতেন বটে, কিন্তু কোনো কোনো ডাক্তার যেমন করেন বলে শুনতে পাওয়া যায় তিনি সেভাবে শুধু তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার ওপরই ভরসা না করে সব সময় একটি দুর্ভেয় ধরনের প্রেসক্রিপশন রেখে যেতেন। এমন কিছু কিছু ডাক্তার ছিলেন যারা কোনোরকম ব্যাখ্যা না দিয়ে শুধু প্রেসক্রিপশনই রেখে যেতেন; তিনি এই শ্রেণির ডাক্তারের দলে ছিলেন না। এ থেকে বোঝা যাবে যে আমি একজন বিবেচক ব্যক্তির বর্ণনা করছি এবং ঠিকই এই কারণেই ডাক্তার স্লোপার তাঁর অঞ্চলে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন। যে সময় তাঁকে নিয়ে আমাদের কারবার, সে সময়ে তাঁর বয়স ছিল বছর পঞ্চাশেক, এবং তিনি উঠেছিলেন জনপ্রিয়তার উচ্চতর শিখরে। লোকটি ছিলেন সুরসিক, এবং নিউইয়র্ক শহরের সেরা সমাজে তিনি দুনিয়াদারিতে বিচক্ষণ ব্যক্তি বলেই পরিগণিত হতেন—আর সত্যিই তিনি বিশেষভাবে তাই ছিলেনও বটে।
(১৮৪০-১৯১৬) একটি সরস লেখা রচনা করতে গেলে যেমন রচয়িতার চাই অভিজ্ঞতা, বাস্তববোধ আর অপূর্ব বস্তু নির্মাণের প্রতিভা, তেমনি সার্থক সাহিত্য সৃষ্টি করতে হলে সাহিত্যিকের মধ্যে চাই অনুরূপ গুণের সমাবেশ। হেনরি জেমসের চরিত্রে উপরোক্ত গুণাবলির সমাবেশ ঘটেছিল, আর তাই তিনি লাভ করেছিলেন কালজয়ী সাহিত্যিকের সম্মান। আমেরিকার উপন্যাস জগতে তিনি একদিন যে ভাবনার ঢেউ তুলেছিলেন, তার তরঙ্গ প্লাবিত করেছিল সারা বিশ্ব । তার গভীর মনস্ততত্ত্বমূলক উপন্যাসগুলো আজও সৎ পাঠকের মনকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। বিশটির বেশি প্রথম শ্রেণির উপন্যাস, এক শতেরও বেশি কাহিনি তিনি তার আগ্রহী পাঠকদের উপহার দিয়েছেন। হেনরি জেমস উপন্যাস সম্বন্ধে একটি সুচিন্তিত মতবাদ পোষণ করতেন : “বিভিন্ন চরিত্র তাদের স্বাভাবিক ক্রিয়া-কলাপের মাধ্যমে নিজস্ব বিশেষত্বের বিকাশ ঘটাবে আর সঙ্গে সঙ্গে গড়ে উঠবে একটি বলিষ্ঠ কাহিনি।” ভ্রমণ যে সাহিত্যিকের চিত্তকে পুষ্ট করে তা তিনি জানতেন। তাই বহুদিন তাকে ভ্রাম্যমাণ জীবন-যাপন করতে হয়েছে। এই সময়কার অভিজ্ঞতার মণি-মানিক্যগুলো সযত্নে তিনি তুলে রেখেছেন তার সৃষ্টির ভাণ্ডারে । বাল্যকালে বড় বেশি অনুভূতিপ্রবণ ছিলেন হেনরি জেমস। একান্ত রাজুক স্বাভাবের এই বালকটি পরবর্তী জীবনে যে বিস্ময়কর কথাকার রূপে বিশ্ববাসীর প্রীতি ও শ্রদ্ধা এমনভাবে আকর্ষণ করতে পারবেন, তা কে জানত।