"আল্বেরুনি" বইটির ভুমিকা থেকে নেয়াঃ মধ্যযুগের মুসলিম গাণিতিক ও বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে খারিজমি, আলবেরুনি, আবু সিনা, আল হাজেন, ওমর খইয়াম, জাবির প্রমুখের নাম বিখ্যাত। তাদের মধ্যে আলবেরুনির বিশেষত্ব হলাে, তিনি আরবি, ফারসি, গ্রিক, হিব্রু, অরামীয় ছাড়া সংস্কৃত ভাষায়ও সুপণ্ডিত ছিলেন। এমন একজন প্রতিভাবান ও মানবদরদি বৈজ্ঞানিকের জীবনাম ও চরিত্রকে লেখক এই উপন্যাসের মধ্য দিয়ে অতি মনােরমভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। আবু রায়হান আল্বেরুনি কেমন জ্ঞান-পাগল কেতাব পড়ুয়া এবং সঙ্গে সঙ্গে মৌলিক চিন্তার অধিকারী ছিলেন তার পরিচয় প্রথম পর্বেই পাওয়া যায়-যখন তিনি কেতাবের পােটলা নিয়ে জুরজানের পথে চলবার সময় ডাকাতদের হাতে পড়ে ঐ পােটলা বাচাবার জন্য ক্লেশ ও নির্যাতন ভােগ করেছিলেন। আর ধর্মশাস্ত্র সম্বন্ধে মানুষের মনে যে কত বিচিত্র ধারণা রয়েছে তারও পরিচয় পাওয়া যায় এবইয়ের সর্বত্র-ডাকাতের মুখে, রাজদরবারের আলেমদের শিক্ষা ও উপদেশদানের মধ্যে-আরব, পারস্য, গ্রিস, রােম ও হিন্দুস্থানের বিদ্বজ্জনের কথাবার্তার মধ্যে। মানুষের মনে সহজেই পুরাতন বা সনাতন জ্ঞান পাথরের মতাে শক্ত হয়ে স্থিতি লাভ করে। যেসব সাহসী লােক সেই স্থিরতা সম্প্রসারণ করতে যান, তারা রক্ষণশীলদের এবং তাদের দল-বলের কাছ থেকে প্রবল বাধার সম্মুখীন হয়ে থাকেন। এসবের জন্য কত রকমের যে যুক্তি তর্কের সৃষ্টি হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এইরূপ সংগ্রামের ভেতর দিয়েই জ্ঞানের উন্নতি হয়। মানবপ্রকৃতির এই স্থবিরতা ও জঙ্গমতার মধ্যে রাস টেনে ধরবার কাজ করেন উদার-প্রকৃতির পরমতসহিষ্ণু ব্যক্তিরা। সমাজে বাস করতে হলে কিছুটা আপস না করে উপায় নেই। নানা ঘটনার ভেতর দিয়ে কার্যক্ষেত্রে প্রবলের সঙ্গে আপস করে কত মনকষ্টে ও সতর্কভাবে আবেরুনিকে চলতে হয়েছে, বর্তমান লেখক সে সবের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন, আর কি সূক্ষ্ম নৈতিক সততার সঙ্গে এই ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ নিজের ত্রুটি-বিচ্যুতিকে বিচার করেছেন তা সত্যিই প্রশংসার যােগ্য। তার মনে জ্ঞানের অহংকার নেই, তিনি সর্বদা সকলের কাছ থেকেই শিক্ষালাভ করতে উৎসুক; আবার পাত্র অনুসারে যথাযােগ্য জ্ঞান দান করতেও উদ্গ্রীব। এর মনে হিন্দু-মুসলিম বা আরবি-ইরানি, গ্রিক-হিন্দুস্তানি জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য নেই, জ্ঞান জ্ঞানই, যেখান থেকে পাওয়া যায় সেখান থেকেই গ্রহণ করতে হবে। আর বাহ্যত নৃশংস অত্যাচারী সুলতানদের মনেও যে জ্ঞান-লিপ্সা ও মহম্ভব লুকিয়ে থাকে, কেউ যে নিছক ভালাে বা নিছক মন্দ নয়; ভালােমন্দ অনেকটা বাস্তব পরিস্থিতি দ্বারা প্রভাবিত হয়, আলােচ্য উপন্যাসে এসব চিন্তারও বহু উদাহরণ রয়েছে। যেমন- ১. জুরজানের সুলতানের সঙ্গে কথােপকথন: সুলতান-আপনি বলছেন, রাজা প্রজাদের প্রতিনিধি। কিন্তু যাকে প্রতিনিধি বলছেন, তিনি ভালােমন্দ যাই করুন না কেন, তার উপর কোনাে কথা বলবার অধিকার তাদের নেই-সে যােগ্যতাও নেই। আ. বে.- মুসলিম জগতের আদর্শ যারা, সেই খােলাফায়ে রাশেদিন কিন্তু (নিজেদের) প্রজাদের প্রতিনিধিস্থানীয় বলে মনে করতেন। শুধু মনে করা নয়, সেইভাবেই তারা জীবনযাপন করে গেছেন। আপনি নিশ্চয় তাদের কথা জানেন। সুলতান-হ্যাঁ, জানি। কিন্তু তাদের আদর্শ শেষ পর্যন্ত আদর্শই থেকে গেল, বাজারে টিকে থাকতে পারল না। তাদের আমল শেষ হবার পর উম্মীয় বংশের রাজত্বের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত কী আরব, কী মিশর, কী স্পেন, এআদর্শ কোথাও টিকে থাকতে পারল না। যা অচল তা চলে না, যা ভঙ্গুর তা ভাঙবেই। ২. খারিজমের সুলতান মামুনের সঙ্গে কথােপকথন: আ. বে-আপনি আর সবার চেয়ে আমার প্রতি অনেক বেশি অনুগ্রহ প্রকাশ করে থাকেন, সেজন্য আমি মনে মনে বেশ একটু অস্বস্তিবােধ করি। অন্যরাও হয়তাে এ জন্য মনঃক্ষুন্ন হয়। হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। সুলতান-আচ্ছা, আপনার কাছে একটা প্রশ্ন : আমার ধারণা ছিল জ্ঞান মানুষের মনকে প্রসারিত করে, উদার করে, আমার এই ধারণা কি ভ্রান্ত? আ. বে.-কেন, একথা বলছেন কেন? সুলতান-আমার দরবারে যেসমস্ত আলেম আছেন তারা সবাই জ্ঞানের জন্য প্রসিদ্ধ। কিন্তু মাঝেমধ্যে তাদের মধ্যে এমন সংকীর্ণচিত্ত মনা পাই। বড় দুঃখও পাই।... এসব কথা যে কারাে কাছেই খুলে বলা যায় না, মনে মনেই হজম করতে হয়... আজ হঠাৎ বলে (আপনার কাছে) ফেললাম। এবং পরস্পর সম্পর্কে ঈর্ষা ও বিদ্বেষের পরিচয় পাই, তাতে স্তম্ভিত হয়ে। আ. বে.-আমরা মানুষ, বড় থেকে ছােট সবাই রক্ত মাংসে গড়া, সবাই অল্পবিস্তর দুর্বলতার অধীন। সেজন্য পরস্পরকে যতটা সম্ভব ক্ষমা করতে শেখা উচিত। সুলতান-উঁহু, আপনি এড়িয়ে গেলেন। এ ক্ষমা করা, না করার প্রশ্ন নয়। আমার জিজ্ঞাসা, এ কেমন করে হয়, কেন হয়? আমি জানি নে, এসব সংলাপ কি আবেরুনির নিজের রচনা না গ্রন্থকার আলুবেরুনির জীবনচরিত্র ভালাে করে পড়ে, আত্মস্থ করে নিজের মতাে করে এইভাবে প্রকাশ করতে পেরেছেন। যদি শেষের অনুমানটাই ঠিক হয় তাহলে আমি একে মনে করব অসাধারণ কৃতিত্ব। চরিত্রের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দক্ষ নাট্যকারের মতাে ভিন্দেশীয় চরিত্র এমন নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তােলার মতাে সাহিত্যিক এ পর্যন্ত আমার নজরে পড়েনি। তাইতেই আমার মনে হয়েছে বইখানা ঠিক হুবহু অনুবাদ তাে নয়ই-কারণ, এমন স্বাভাবিক চমক্কার বাংলায় ইংরেজি বা অন্যভাষা থেকে অনুবাদ করাও অতিশয় দুরূহ কাজ। তাই আমার বিশ্বাস, লেখক। বহুদিন ধরে বহু পরিশ্রম করে অশেষ ধৈর্যের সঙ্গে সমস্ত ব্যাপার। আত্মসাৎ করে, ঘটনা কিছু সংক্ষিপ্ত করে, মূল সংলাপগুলাের মর্ম ঠিক রেখে অনুবাদ করেছেন। লেখক এই বইয়ের মারফতে এমন একজন মহাব্যক্তিত্বশীল সাহিত্যিক, ভাবুক ও লােকপ্রেমিককে বাংলা পাঠকদের কাছে পরিচিত করে দিচ্ছেন যে, এই কাজকে আমি অশেষ পুণ্যের কাজ বলে মনে করি। আশা করি, পাঠক সমাজ এই বই পড়ে আনন্দ পাবেন আর আত্মােন্নতির মতাে মহৎ ফলও পাবেন।