মোস্তফা তানিম লেখালেখি করছেন দুই দশক ধরে। বাংলাদেশের যে স্বল্প সংখ্যক লেখক সায়েন্স ফিকশন লিখে পাঠকের মনোযোগ কেড়েছেন, মোস্তফা তানিম তাদেরই একজন। লেখক-তীর্থভূমি হিসেবে খ্যাত ''কচি কাঁচার আসর'' দিয়ে তার লেখক জীবনের সূচনা। নব্বই দশকে পত্রিকার জন্য দুই হাতে লিখেছেন। লেখালেখির মতো তার পেশাও ভীষণভাবেই বিজ্ঞানকেন্দ্রিক। বুয়েটে লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে তিনি পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। এরপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস এ এন্ড এম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি একটি মার্কিন আই,টি, কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কর্মরত আছেন। বিজ্ঞান তার একটা প্রিয় বিষয়, তার লেখায় সেটার স্পষ্ট ছাপ পড়েছে। বিজ্ঞানের সাথে কলার বিরোধ আছে। মোস্তফা তানিম অসামান্য দক্ষতায় সেই বিরোধ সামলান তো বটেই, মাঝে মাঝে দু'টোকে বেশ দারুনভাবে সমন্বয় করেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ন'টি।
বইটি মূলত সাইন্স ফিকশান ভিত্তিক দুটি গল্প নিয়ে সাজানো হয়েছে। একটি রিংটোন এবং অন্যটির নাম রঙ নাম্বার। সাইন্স ফিকশান পড়তে যারা ভালোবাসেন তাদের কাছে বইটি ভালো লাগার কথা। বর্তমানে নতুন লেখকদের সাইন্স ফিকশান বলতেই সন্দেহ হয়। মনে হয় ইনিও বুঝি জাফর ইকবাল স্যারের থেকে বিভিন্ন জিনিস কপি করে বই লিখে ফেলেছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে আমি খুব সন্তুষ্ট। লেখকের নিজস্ব ধারা রয়েছে। ফিকশান দুটিও সম্পূর্ণ অন্যরকম। তাই যারা সাইন্স ফিকশান ভালোবাসেন‚ পড়ে মজা পাবেন আশা করছি।
রিংটোনঃ গল্পে মূল চরিত্র পুষ্পিতা। বাবা-মা মারা যাবার পর চাচা চাচীর সাথে একই বাড়িতে থাকে। দারুণ রুপবতী এবং কিঞ্চিত অসামাজিক হিসেবেই সবার কাছে পরিচিত পুষ্পিতা। আরমান নামক এক ছেলের প্রেমে ব্যর্থ হয়ে অনেকটাই একলা জীবন যাপন করতে পছন্দ করে।
হুট করেই কিছুদিন ধরে পুষ্পিতা একটা রিংটোন শুনতে পায়। কিন্তু সারারুম তন্ন তন্ন করে খুঁজবার পরেও রিংটোনের উৎস খুঁজে পেতে ব্যর্থ সে। তাই ফোন খুঁজতে বাড়ির চাকর বকরের সাহায্য নিল। কিন্তু সমস্যা হলো রিংটোনটি শুধু পুষ্পিতা ছাড়া আর কেউই শুনতে পায় না। কথাটা যখন পুরো বাড়ি জানাজানি হয়ে গেল তখন সবাই ধরে নিল একা থাকতে থাকতে পুষ্পিতা ধীরে ধীরে পাগল হয়ে যাচ্ছে। গল্পের আরেকটি মূল ক্যারেক্টার বিজ্ঞানী ড.শিবলী। একটি গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত আছেন তিনি। গল্পে দেখানো হয় তিনি এক অভিনব প্রযুক্তিতে আন্তঃনাক্ষত্রিক সংবাদ পাঠাতে পারছেন। আর এর মাধ্যমেই তিনি সবার আড়ালে মহাজাগতিক প্রাণীদের সাথে যোগাযোগ করতে পারছেন।
শিবলীর চরিত্রটি আসার পরই গল্পে মোড় ঘুরে যায়। সাইন্স ফিকশানের মূল ব্যাপারটা তখনই সামনে আসে। লেখক এখানে বেশ চতুরতার সাথেই সব কিছু জুড়েছেন। ফিনিশিংটাও বেশ ভালো হয়েছে। সাইন্স ফিকশান যারা পড়েন না তাদের কাছেও গল্পটা খারাপ লাগার কথা না। গল্প হিউমারাস করার জন্য বাস্তব জীবনে মিল রেখে অনেক কিছুই লেখক তুলে ধরেছেন।
রঙ নাম্বারঃ আমার কাছে ১ম গল্পের চেয়ে রঙ নাম্বারই বেশি ভালো লেগেছে। গল্প মূল চরিত্র আতিক এবং এরফান নামক দুটি যুবক। তবে গল্পের পুরোটাই একটি ফোনকে ঘিরে।
গল্পের আতিক আইফোন ইলেভেন ভেবে গুলিস্তানের চোরাই মার্কেট থেকে একজনের কাছে ফোনটি ক্রয় করে। কিন্তু সমস্যা হলো তখনো আইফোন এলেভেন ভার্শন বেরই হয় নি। এই গল্পটি নিয়ে একটু বেশি বললেই গল্পের স্পয়লার দেওয়া হয়ে যাবে। শুধু বলি ফোনটি সাধারণ কোনো ফোন ছিল না ওই ফোন দিয়ে টাইম ট্রাভেল করা যায়।
এই গল্পে লেখক পাঠকদের মাঝে এক ধরণের কৌতুহল সৃষ্টি করতে পারবে। তবে আমার মনে হয়েছে ফিনিশিংটা অন্যরকম হলেও পারত। যেমন আতিক যদি ফোনের সেটিং মেন্যুর মধ্যের ফরগট অল অপশনটা না চাপত তবে কাহিনী আরো ইন্টারেস্টিং হতে পারত।
ছোটবেলা থেকেই আমার প্রচণ্ড আগ্রহ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিতে। ছুটিতে যখন বাসায় আসতাম ক্যাডেট কলেজ থেকে কয়েক সপ্তাহের জন্য, সারাদিন বুঁদ হয়ে থাকতাম বইয়ের মধ্যে। অন্যান্য বইয়ের মধ্যে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি এবং রোমাঞ্চ উপন্যাস ছিল অন্যতম। বয়স বাড়ার সাথে সাথে রোমাঞ্চ উপন্যাসের প্রতি ঝোক কমে গেলেও ভালো বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি এখনো আমাকে ভীষনভাবে নাড়া দেয়। এই বইগুলো আমাকে আমার পরিচিত বিজ্ঞানের জগতের বাইরে নিয়ে যায়। যে জগতটা আপাত অসম্ভব মনে হলেও বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার কোন একদিন সম্ভব করেও ফেলতে পারে।
বাংলাদেশে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির সংখ্যা অপ্রতুল। সে ঘাটতি কমাতে এগিয়ে এসেছে মোস্তফা তানিম। মোস্তফা তানিমকে চিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সে কবিতা লেখে, রম্যরচনা লেখে, এবং প্রবন্ধ লেখে জানতাম। কিছু কিছু পড়েছি এবং সেসবের মধ্যে কিছু লেখা পড়ে মুগ্ধও হয়েছি। মাসখানেক আগে মোস্তফা তানিম যখন জানাল যে সে একটা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির বই বের করছে একুশে বইমেলায়, আমিতো যারপরনাই আনন্দিত। মোস্তফা তানিম অনুরোধ জানাল বইটি পড়ে আমার মতামত জানাতে। বই ছেপে বেরোনোর আগেই পড়ার সুযোগ পাবো ভেবে সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম। পড়ে শেষ করতে একটু সময় লাগল এবং বইটি ইতিমধ্যে বইমেলায় বেরিয়ে গেছে।
দুটি বড় গল্প – ‘রিংটোন’ এবং ‘রং নাম্বার’ – নিয়ে এ বই। খুউবই মজার দুটো গল্প। প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও দুটো গল্পেরই উপাত্ত ফোন এবং সময়। ফোনকে যোগাযোগের মাধ্যম করে সময়ের ভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত চরিত্রগুলো গড়ে তোলে নতুন সম্পর্ক, যোগ করে পুরাতন সম্পর্কে নতুন মাত্রা। তানিম গল্পচ্ছলে পাঠকদের নিয়ে যায় এক কাল্পনিক জগতে। রিংটোন আর রং নাম্বার আমাদের কল্পনার দিগন্ত প্রসারিত করে নিয়ে যায় অসীমে; ঠিক যখনি আমরা অবাস্তবকে বাস্তব ভাবতে শুরু করি তখনি লেখক তানিম আমাদের ধীরে ফিরিয়ে নিয়ে আসে বৈজ্ঞানিক বাস্তবতায় এবং যুক্তির মাধ্যমে বুঝিয়ে দেয় অবাস্তব কিভাবে ভবিষ্যতে হয়ে উঠতে পারে বাস্তব। আমরা হাফ ছেড়ে বাঁচি, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি, এবং তৃপ্তির ঢেকুর তুলি। রিংটোনের প্রতি আমার ভালোলাগাটা একটু বেশী হলেও, দুটো গল্প পড়েই আমি ভীষণ আপ্লুত।
মোস্তফা তানিমের লেখার হাত আরো শানিত হোক, পরিপক্ক হোক এই আশা করি। ওর হাতে আরো অনেক বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির জন্ম হবে এই আশায় থাকলাম।
Read More
Was this review helpful to you?
By Halima Zaman,
09 Feb 2018
Verified Purchase
"বৃক্ষ তুমি কে? ফলে পরিচয়"। লেখক তানিম ভাই এর ক্ষেত্রে এই কথাটা বেশ খাটে। আমি যখন "রিংটোন এবং রং নাম্বার " বইটা পড়ছি ঐ মুহূর্তে আমি জানতাম না বইটা কেমন হবে। বইটা মূলত দুইটা গল্পের সমন্বয়ে। রিংটোন গল্পের শুরু থেকেই বেশ জমানো মনে হয়েছে আমার। সব মিলিয়ে আমরা মানুষ হিসেবে যে কতটা গতানুগতিক সেটাও স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছেন লেখক। এই একবিংশ শতাব্দীতেও কত সহজে একটা মানুষের একটা দুর্দান্ত বিশ্লেষণকে কেমন করে তাকে মানসিক রোগী বলে প্রমাণ করে সেটাও অবাক করা- তবে সেটাই বাস্তব। এই খুঁটিনাটি বিষয়গুলোর মাধম্যে লেখক আমাদের সমাজের মানুষের কিছু কুসংস্কারমূলক ব্যখ্যাও তুলে ধরেছেন। মোটের উপর বই এর প্রথম গল্প রিংটোনটা ভালো লাগার কারণেই আমি পরের গল্পে অগ্রসর হই। তানিম ভাইয়ের কাছে শুনলাম পাঠকদের কাছে রিংটোনটা বেশি ভালো লেগেছে রংনাম্বারের চেয়ে। আমার ক্ষেত্রে উল্টো। আমার কাছে মনে হয়েছে রং নাম্বার গল্পটায় সাস্পেন্স খুব বেশি ছিল আর যে কারণে আমি পুরো গল্পটা শেষ না করে উঠতে পারিনি। একদিন থেকে চিন্তা করতে গেলে টাইম ফোন বা টাইম মোবাইল এর এই ধারণাটা বেশ ফিল্মি। কিন্তু একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে বোঝা যাবে যে টাইম ফোনের মত কিছু যদি আজ থেকে শত বছর পরে চালু হয় তবে তখন কিন্তু সেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এই ধারণা অতি সাধারণ ই মনে হবে। আমি পুরো গল্পটা যথেষ্ট মজা নিয়েই পড়েছি। বিজ্ঞান এর বিষয়গুলো একটু কম বুঝলেও গল্পের আকারে যে কোন বিষয়ই খুব জলদি আকর্ষণ করে যে কাউকে। আমার ক্ষেত্রের ও এমনটাই হয়েছে বোধ করি। অনেক অনেক শুভ কামনা তানিম ভাই আপনাকে আপনার "রিংটোন এবং রং নাম্বার " এবং আগামী আরও শ' খানেক বই যেগুলো উপহার দিবেন আমাদের সেগুলোর জন্য।
হালিমা জামান মিথিলা
Read More
Was this review helpful to you?
By Masud,
10 Feb 2018
Verified Purchase
প্রায় এক বসায় বইটা পড়ে ফেললাম। এটা যদিও সায়েন্স ফিকশান, কিন্তু কঠিন বা রোবটের সায়েন্স ফিকশন না। খুব অবাক হয়ে গেলাম, একেবারে আশেপাশের মানুষকে নিয়ে দারুন একটা সায়েন্স ফিকশন লিখেছেন মোস্তফা তানিম। একটা ঘোরের মধ্যেই নিয়ে গেলেন লেখক, রহস্য আর ভালো লাগার ঘোর। এমন বই আরো চাই।