কোনো বই নিজের করে নিতে হলে প্রথমে আমরা কী দেখি? উত্তরে বলতে হয় : বইয়ের নাম, প্রচ্ছদকর্ম, বিষয় এবং মুদ্রণ সৌকর্য। হ্যাঁ, লেখক তো প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে পাঠক-ক্রেতার মনকে দখল করে থাকবেনই। যদিও সেটা নির্ভর করে লেখকের মনন, মেধা, নিজস্বতা এবং জনপ্রিয়তার পরিধির ওপর। আলোচ্য কাব্যগ্রন্থ ‘কে তুমি তন্দ্রাহরণী’র কবি বদিউল আলম কাব্যপ্রিয় বিদগ্ধজনের কাছে কোনো সচরাচর নাম নয়- তবে তার কাব্যগ্রন্থে আশ্রিত কবিতাগুলো স্বাভাবিক বিশিষ্টতার দাবি রাখে। কাব্যগ্রন্থ ‘কে তুমি তন্দ্রাহরণী’র প্রকাশকাল অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৮। গ্রন্থে সন্নিবেশিত ৪১টি কবিতায় কবি স্মরণ করেছেন তার তন্দ্রাহারা প্রেমময় জীবনের স্মৃতিকাতরতাকে কবির স্মৃতিপটের প্রিয় মুখগুলো তার বিদ্যালয় ক্যাম্পাসেরই। তন্দ্রাহারা কাব্যচর্চায় তিনি খোঁজেন হারানো প্রেমকে। কাব্যগ্রন্থের নাম কবিতায় তাইতো কবির কাতর উচ্চারণ- ‘যুগ যুগ ধরে খুঁজেছি তোমায় নিরবধি খুঁজছি তিল তিল কামনার অঙ্গারে দিনে দিনে পুড়ছি দেখা মেলে না তোমার শুধু দূরাভাষে প্রেমালাপ। (কে তুমি তন্দ্রাহরণী, পৃ. ৩৩) এখানে ‘দূরাভাষে প্রেমালাপ’ হচ্ছে নাগরিক জীবনের জটিল প্রেম। সেই জটিলতাসত্তেও কবির হৃদয়ের আকুতি একই কবিতায় উচ্চারিত। ‘আজো হৃদয় জাগে তোমার হিয়া পরশিয়া আমার স্বপ্নচারিণী ওগো ভুবন মোহিনী অন্তর্যামী জানে তুমি যে আমার তন্দ্রাহরণী...।’ ‘কে তুমি তন্দ্রাহরণী’ কাব্যগ্রন্থটিতে এমনি আরো কয়েকটি বলিষ্ঠ কবিতা হচ্ছে- ভিজিয়ে প্রিয়ার বুক চুমিব অমৃত ধারায় (পৃ. ৭), প্রিয়ার বুকে বয়ে যায় অশ্রæনদী (পৃ. ৯), ভালোবাসার চিতায় অশ্রæর মঞ্জরী (পৃ. ৩০), হারানো প্রিয়ার শিস দিয়ে ডাকা কাকভোর (পৃ. ৫৭)। শুধু প্রেম নয়, দ্রোহ-বিদ্রোহের কথাও আছে। রাজনৈতিক সচেতন কবি মহান নেতা বঙ্গন্ধুকে স্মরণ করেন এভাবে- ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু। সংগ্রাম কী হয়েছে শেষ পেয়েছে কী মুক্তি স্বদেশ।’ (পৃ. ৫২) এক সাগর রক্তের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতার কাছে প্রশ্ন ‘হে স্বাধীনতা, তুমি মুখ খুলে বলো তুমি কার।...চোখ খুলে দেখ আঠার কোটি প্রাণের হাহাকার (পৃ. ৫৪)। কাব্যগ্রন্থজুড়ে রয়েছে কবির নিজস্ব ভাষা প্রয়োগপ্রবণতা। বিচিত্র, অভিনব উপমা-উৎপ্রেক্ষায় কিছু নমুনা কবিতা : কাশবন যেন যৌবনের বিয়ের কাবিন, পৃ. ২২। পেয়ালায় ফাল্গুন, পৃ. ৬২। ধর্ম-সংস্কৃতির অপূর্ব মেলবন্ধনের উদাহরণে পাওয়া যাবে ‘ঈদ আসে মহাখুশির ঈদ’-এর মতো কবিতার পাশাপাশি ‘বৈরী ভুবনে বৈশাখে রাবণ’ (পৃ. ৩১), বৈসাবী উৎসব সংক্রান্ত কবিতা। মুদ্রণ সৌকর্যের সার্বিক মান বজায় রেখে সাহিত্যদেশ প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থটি কবি ও কবিতাপ্রিয় পাঠকমহলে দৃষ্টি আকর্ষণ করবে বলেই অনুমিত হয়। চিত্রশিল্পী সোহানুর রহমান অনন্ত অঙ্কিত নান্দনিক প্রচ্ছদের ‘কে তুমি তন্দ্রাহরণী’ কাব্যগ্রন্থটির বোর্ড বাঁধাই মূল্য ১৩৫ টাকা। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৬৪। আধুনিক কাব্যমনস্ক কবি বদিউল আলম ‘কে তুমি তন্দ্রাহরণী’ কাব্যে গ্রামবাংলার কৃষ্টি এবং মধ্যবিত্তের জীবন চেতনাকে শাণিতভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন। কাব্যগ্রন্থটির বহুল পাঠপ্রিয়তা কামনা করি।
বদিউল আলম। কবি, গল্পকার ও ঔপন্যাসিক। তিনি ১৯৫৬ সালের ৫ মে, চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলায় খাজুরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মরহুম হাজী সেকান্দর আলী মিয়া। মা মোসাম্মৎ ফাতেমা বেগম। কবি বদিউল আলম চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় হতে স্নাতক (সম্মান) ও মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ১৯৮২ সালের বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারে যোগদান করেন। মাঠপর্যায়ে কর্মরত থাকাকালে তিনি বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছেন। সরকারের যুগ্মসচিব পদ থেকে তিনি অবসরে এসে সাহিত্যাঙ্গণে পূর্ণ মনোনিবেশ করেন। নিসর্গপ্রেম, বিরহ, বেদনা, বাস্তবতা, সামাজিক, মনস্তাত্তি¡ক ও মানবিক বিষয়গুলো কবির কবিতায় নান্দনিক এবং সাবলীলভাবে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি একই সঙ্গে কবি, গল্পকার ও ঔপন্যাসিক। তাঁর প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ জুলুভাই (২০১৯) ও উপন্যাস- ফারু (২০১৯) শাহেদ (২০২০) শেষ উপহার (২০২০) কবরী (২০১২১) দেশে ও বিদেশে বাঙালি পাঠকদের ভূঁয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছে এবং আলোচিত ও সমাদৃত হয়েছে। তাঁর কাব্যগ্রন্থ- বলাকার দেশে (২০১৮), কে তুমি তন্দ্রাহরণী (২০১৮), সূর্যাস্তের সাথেই যাব (২০১৯), গোলাপ ছুঁয়েছি নিমগ্ন আবেগে (২০১৯) কবি মহলে ও কবিতাপ্রেমিদের মধ্যে ব্যাপকভাবে সাড়া জাগিয়েছে। ‘শিশিরের ঠোঁটে বেদনার নীল’ তাঁর পঞ্চম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ। এই কাব্যগ্রন্থে তাঁকে পাওয়া যাবে আরও পরিণত ও কাব্যদৃষ্টি সম্পন্ন একজন পরিপূর্ণ কবি রূপে।