ভালোবাসার কি কোন বস্তুগত রূপ আছে? যদি নাই থাকে তবে ভালোবাসা কি করে ফেরারি আসামি? কবি ইফতেখার হালিম ভালোবাসাকে আবিস্কার করেছেন ফেরারি আসামি রূপে! ভালোবাসার তবে অপরাধ কি? কে তার বিচার করলো? কে তাকে সাজা দিলো? কি করে ফেরারি হলো ভালোবাসা? বলতে গেলে পৃথিবীতে প্রতিটি বস্তুর সাথে প্রতিটি বস্তুর ভালোবাসা বিদ্যমান। আমরা যেমন বাতাস দেখতে পাই না তেমনি ভালোবাসাও দেখা যায় না। ভালোবাসা মূলত অনুভব করার বিষয়। এ ভালোবাসার নানা রূপ রস রঙ আছে। যে যেভাবে ভালোবাসাকে অনুভব করে ভালোবাসা তার কাছে সেভাবে ধরা দেয়। ‘দিন দিন বাড়ছে স্বপ্নভঙ্গের ব্যাকুলতা/বাতাসে বেদনার সুর/আত্মনাদে ক্লান্ত প্রকৃতি/বুকে ভাঙনের শব্দ/কান্নার শব্দ বাড়ায় আতঙ্ক/মানুষ এখন প্রাণহীন মূর্তির মতো/শুধু চেয়ে থাকে/না কাঁদতে পারে, না হাসতে পারে/এখন অস্ত্রেও উন্মাদনায় অশুভ আচরণ/অজানা অস্থিরতায় হাতছানি বাড়ছে/বাড়ছে বিভাজন, বাড়ছে বিনাশ/বাড়ছে শোষকের তৃষ্ণা, বাড়ছে কান্নার রোল/এখন ভালোবাসা ফেরারি আসামি।’ (ভালোবাসা ফেরারি আসামি/পৃষ্ঠা-৪৮) ৪৮ পৃষ্ঠার এই বইটিতে রয়েছে ৪২টি কবিতা। বইটি প্রকাশিত হয়েছে অমর একুশে বইমেলা ২০১৮ সালে। ১৮/১২/২০১৬ সালে লেখা ‘ফুলের ঘ্রাণে পাই সম্পর্কের চিঠি’ শিরোনামের কবিতাটি দিয়ে এ বইয়ের কবিতাক্রম শুরু হয়। কবি ইফতেখার হালিম সচেতন ও স্বনিয়ন্ত্রক একজন কবি। তার কবিতায় পরিমিত বোধ ও শব্দের ভারসম্যপূর্ন ব্যবহার লক্ষণীয়। তিনি কবিতাকে পরিশীলিত ও প্রয়োজনীয় করে তুলতে আত্মমগ্ন ও আত্মচর্চার মধ্যে যাপন করেন। ‘পকেটে রিজার্ভ থাকে বসুন্ধরা টিস্যু/যা কখনো কখনো সম্পর্কের রুমাল/লাজুক সন্ধ্যায় মানিব্যাগে খুঁজি/ভালোবাসার বিনিময় মুদ্রা/ইতস্তত আঙুল পরিমাপ করে সঞ্চয়ের উষ্ণতা।’ (সম্প্রতির ঘ্রাণ/পৃষ্ঠা-১৪) ‘পকেটে রিজার্ভ থাকে বসুন্ধরা টিস্যু’ এ বাক্যের মধ্যে কেবল রিজার্ভ শব্দটি যুক্ত করে কবি তার কবিতাকে করেছেন অনন্য। টিস্যুকে তিনি করেছেন রুমাল! আসলে কবি কল্পনার বাস্তবতা ও পরাবস্তবতা কবিতার পাঠককে করে পুলকিত! আর পাঠকমনের অলিগলি না ঘুরে যেসব কবিতা লেখা হয় তা হারিয়ে যায়। এ বইয়ের বেশি কিছু কবিতাই স্বমহীমায় পাঠকমনে টিকে থাকবে। ‘উত্তেজিত মেঘের শরীর থেকে পড়ে/ফোঁট ফোঁটা ঘাম/মাটির বুকে বয়ে যায় জলের ¯্রােত/ক্লান্ত বিকেল পায় উৎসবের অজুহাত/তৃষ্ণা মেটায় মাঠ-প্রান্তর/যুবতি তরুলতা।/আকাশের রং হয় মায়ার চিরন্তন প্রেমিক/যুবক রোদের সোহাগে কষ্ট তাড়ায়/যাযাবর পথিক/ক্লান্তিহীন পথে পথে বিলি করে/ভালোবাসার আদিম উষ্ণতা। (প্রেম/পৃষ্ঠা-১১) কবিতা আবেগ-অনুভূতি, উপলব্ধি ও চিন্তা করার সংক্ষিপ্ত রূপ এবং তা অবশ্যই উপমা-উৎপ্রেক্ষা-চিত্রকল্পের সাহায্যে আন্দোলিত সৃষ্টির উদাহরণ। পৃথিবী নামক গ্রহের তাবৎ বিষয়কে পুঁজি করে কবিতা ফলত সুমধুর শ্রæতিযোগ্যতা যুক্ত করে। কাঠামোর বিচারে কবিতা নানা রকম। যুগে যুগে কবিরা কবিতার বৈশিষ্ট্য ও কাঠামোতে পরিবর্তন এনেছেন। কবিতা শিল্পের মহত্তম শাখা পরিগণিত। কবিতার রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস এবং কবিতাকে সংজ্ঞায়িত করার প্রাথমিক প্রচেষ্টা, যেমন এরিস্টটলের পোয়েটিকস, অলঙ্কারশাস্ত্র, নাটক, সংগীত এবং হাস্যরসাত্ম বক্তব্যের বিভিন্ন ব্যবহারসমূহের উপর দৃষ্টিপাত করে। কবিতা কী, তার চেহারা-চরিত্র কীরূপ ইত্যাদি নিয়ে বিস্তর বুদ্ধিবৃত্তিক উৎপাদন হয়েছে। ‘প্রিয় গ্রামের পথটি দখল নিয়েছে/ইট-সুরকি।/গরুর গাড়ি/ এবং ঘোড়ায় চড়ে হাটে যাওয়া/মালামাল পরিবহন আজ অতীত/কাদামাখা পিচ্ছিল পথের আনন্দ/শূন্যতার পালকে পরিত্যক্ত/অচেনা সবুজ লতাপাতার গন্ধময়/প্রিয় গ্রাম।/এখন পরিচিত পথে ক্লান্ত কৃষকের/পায়ের বদলে/দ্রæতবেগে ছুটে চলে বেরসিক ট্রাক।’ (গ্রামীণ ঐতিহ্যের আশ্রয় নাগরিক জাদুঘরে/পৃষ্ঠা-৮) অনেকেই বলেন কবিতা বুঝি না। বুঝতে না পারার কারণ হচ্ছে কবিতা প্রধানতঃ আবেগ-নির্ভর ও যুক্তির ভারশূন্য। কবিতার মধ্যে শব্দের আভিধানিক অর্থের বাইরেও অনুল্লেখিত অর্থ থাকতে পারে। তাই একই কবিতার অর্থ নানা জনের কাছে নানা রকম হতে পারে। কবি ইফতেখার হালিমের কবিতা নানা অর্থেই ধরা দেয়।
ইফতেখার হালিমের জন্ম ১৯৬২ সালের ১৭ই ফেব্রæয়ারি। পিতা মো. আবদুল লতিফ ও মাতা হাজেরা খাতুন। পৈতৃক নিবাস ময়মনসিংহের ঈশ^রগঞ্জ উপজেলার বৃ-কাঠালিয়া গ্রামে। সোহাগী ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয় হতে এসএসসি এবং গৌরীপুর কলেজ হতে এইচএসসি পাস করেন। সৈয়দপুর হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ (নৈশ) হতে ডিএইচএমএস পাস করেন। দুই ভাই ও ছয় বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। ইফতেখার হালিম নামে কবি পরিচিতি পেলেও তাঁর প্রকৃত নাম মো. আবদুল হালিম। বর্তমানে তিনি রেলভবন, ঢাকায় কর্মরত আছেন। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১০টি।