"ভোলগা থেকে গঙ্গা" বইটির 'বাংলা অনুবাদ প্রসঙ্গে' অংশ থেকে নেয়াঃ বন্ধুবর রাহুল সাংকত্যায়নের সুপ্রসিদ্ধ হিন্দী গ্রন্থ ‘ভােলগা সে গঙ্গা’ প্রায় সকল ভারতীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে, বহির্ভারতেও ইংরাজী, বর্মী ভাষায় এর সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। ‘ভােগা সে গঙ্গা' গ্রন্থখানির প্রথম আবেদন এর আখ্যানবস্তু। সমগ্র গ্রন্থটি ছােট ছােট গল্প বা কাহিনী আকারে লেখা কিন্তু এই কাহিনী বা আখ্যানের পিছনে একটি ব্যাখ্যাও রয়েছে। সে ব্যাখ্যা বিরাট পটভূমিকার ওপর ঐতিহাসিক সত্য বস্তুর। প্রায় ছয় হাজার খৃষ্টপূর্বাব্দ কালে ভারতের সুদূর উত্তর পশ্চিমে দক্ষিণ-বাহিনী ভােল্গার তীরে অরণ্যতুষারসমাচ্ছন্ন পরিবেশে যে মানবগােষ্ঠীর পদপাত শােনা গিয়েছিল, তাঁদেরই আবাস, জীবন, প্রেম ও ভালােবাসা নিয়ে এ মহাগ্রন্থের প্রথম দৃশ্যপট উত্তোলিত হয়। তারপর সেই মানুষ ক্রমে মধ্য ভােগা তটে অগ্রসর হয়ে এল, তার সমাজ বিকাশিত হয়ে উঠল, ক্রমে ক্রমে তার ভাষাও বিন্যস্ত হয়ে এল। ক্রমে এই হিন্দী-শ্লাভ ভাষাভাষী মানুষ আরও অগ্রসর হয়ে এল, তরঙ্গের পর তরঙ্গে তারা মধ্য এশিয়া অতিক্রম করে গেল— পামীর, উত্তর কুরুতে তাদের বসতি হল, এ বার জন্ম হল হিন্দী-ইরানীয় ভাষার। ক্রমে তারা স্বাত উপত্যকায় পৌছে গেল, এ বার সারা গান্ধার জুড়ে তাদের আবাস- হিন্দু-আর্য ভাষা তখন জন্ম নিয়েছে, সম্ভবত সেখানেই ঋগ্বেদ রচিত হয়েছিল। ক্রমে সমগ্র গাঙ্গেয় উপত্যকা জুড়ে এই আর্যদের বসতি স্থাপিত হয়েছে। এইভাবে ইতিহাসের ধারা অনুসরণ করে কাহিনীর পর কাহিনীতে বিংশ শতাব্দীতে পৌছে গ্রন্থ সমাপ্ত হয়েছে। গ্রন্থের কাহিনীগুলাে কাহিনী হলেও নিছক কল্পনাপ্রসূত নয়। সমাজবিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ের দিকে লক্ষ্য রেখে গল্পগুলি ধারাবাহিকভাবে রচিত হয়েছে। তাই ইতিহাস আর সমাজ-বিজ্ঞানের মূলতত্ত্বকে কোথাও এড়িয়ে যাওয়া হয়নি। কাহিনীতে কায়ালাভ করে ইতিহাস অনেক ক্ষেত্রেই আরও বাস্তব ও সজীব হয়ে উঠেছে। ভারতীয় সমাজবিকাশের বিভিন্ন পর্যায়গুলি গল্পচ্ছলে অনুধাবন করার পক্ষে সুবিধাজনক, তাই এ গ্রন্থের মূল্য অনস্বীকার্য।
তাঁর জন্ম ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে সনাতন হিন্দু ভূমিহার ব্রাহ্মণ পরিবারে। জন্মস্থান উত্তর প্রদেশের আজমগড়ের একটি ছোট্ট গ্রাম। তাঁর আসল নাম ছিল কেদারনাথ পাণ্ডে। ছোটোবেলাতেই তিনি মাকে হারান। তাঁর পিতা গোবর্ধন পান্ডে ছিলেন একজন কৃষক। বাল্য কালে তিনি একটি গ্রাম্য পাঠশালায় ভর্তি হয়েছিলেন। আর এটিই ছিলো তাঁর জীবনে একমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। অষ্টম শ্রেণী অবধি অধ্যয়ন করেছিলেন। এখানে তিনি উর্দু ও সংস্কৃতের উপর প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। তিনি বহু ভাষায় শিক্ষা করেছিলেন যথা : হিন্দি, উর্দু, বাংলা, পালি, সংস্কৃত, আরবি, ফারসি, ইংরেজি, তিব্বতি ও রুশ।
পুরস্কার তালিকা পদ্মভূষণ (১৯৬৩) সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার (১৯৫৮)
ব্যক্তিগত জীবন জালিওয়ানওয়ালা বাগের হত্যাকান্ড (১৯১৯) তাঁকে একজন শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী কর্মীতে রূপান্তরিত করে। এ সময় ইংরেজ বিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে তাকে আটক করা হয় এবং তিন বছরের কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। এ সময়টিতে তিনি পবিত্র কুরআন শরীফ সংস্কৃতে অনুবাদ করেন। পালি ও সিংহল ভাষা শিখে তিনি মূল বৌদ্ধ গ্রন্থগুলো পড়া শুরু করেন। এ সময় তিনি বৌদ্ধ ধর্ম দ্বারা আকৃষ্ট হন এবং নিজ নাম পরিবর্তন করে রাখেন রাহুল (বুদ্ধের পুত্রের নামানুসারে) সাংকৃত্যায়ন (আত্তীকরণ করে যে)।, জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি বিহারে চলে যান এবং ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ-এর সাথে কাজ করা শুরু করেন। তিনি গান্ধিজীর আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন এবং এসময় তিনি গান্ধীজী প্রণীত কর্মসূচীতে যোগদান করেন। যদিও তাঁর কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ছিলো না, তবুও তার অসাধারণ পান্ডিত্যের জন্য রাশিয়ায় থাকাকালীন লেনিনগ্রাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে শিক্ষকতার অনুরোধ করা হয়। তিনি তা গ্রহণ করেছিলেন। ভারতে এসে তিনি ডঃ কমলা নামক একজন ভারতীয় নেপালি মহিলা কে বিয়ে করেন। তাদের দুই সন্তান হয়, কন্যা জয়া ও পুত্র জিৎ। পরে শ্রীলংকায় (তৎকালীন সিংহল) বিদ্যালঙ্কার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এখানে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে দার্জিলিংয়ে, ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দের ১৪ এপ্রিল তারিখে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।