"বাংলাদেশ বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর" বইটির প্রথম ফ্ল্যাপ-এর লেখাঃ রাজনীতি যারা করেন তারাই রাজনীতিক এবং দেশ ও দেশবাসীকে সঠিক পথে পরিচালনার রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব তাদের হাতেই থাকার কথা। বিশেষত গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এমন একটি ধারণাকে স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে ধরে নেয়া হলেও তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশ বিভিন্ন কারণে এবং বিভিন্ন সময়ে তা অনুসরণ করে চলেনি। ওই দেশগুলােয় কারণ ও সময়ের যােগসূত্র ঘটিয়ে সমরনীতিকরাও আবির্ভূত হয়েছেন। রাজনীতিতে, দেশ ও দেশবাসীকে পরিচালনার জন্যে কর্তৃত্ব নিয়েছেন রাষ্ট্রক্ষমতার। কখনাে রাজনৈতিক দীনতা কিংবা দেশ ও দেশবাসীকে পরিচালনায় রাজনীতিকদের ব্যর্থতা রাজনীতিতে সমরনীতিকদের আগমনের পথ মসৃণ করে দিয়েছে। আবার কখনাে অনুকূল সময়ের প্রবাহে বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রক্ষমতায় জেঁকে বসেছে সেনানিবাসের অযাচিত উচ্চাভিলাষ। দারিদ্র্যপীড়িত এশীয় অঞ্চলে এই দুই প্রক্রিয়াতেই রাজনীতিতে সমরনীতি কিংবা গণতন্ত্রে সমরতন্ত্র একাকার হয়েছে বহুবার। এই অঞ্চলেরই দক্ষিণ বলয়ের একটি দেশ বাংলাদেশেরও তার স্বাধীনতা লাভের মাত্র তিন দশকের সীমিত সময়ে রাজনৈতিক টানাপােড়েনের সরুপথে একাধিকবার সশস্ত্র বাহিনীর অধিষ্ঠান ঘটেছে রাজনীতিতে এবং এই ধারাপ্রবাহের একটি বিশাল অংশ তার শক্ত অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে রাজনীতিতে। সশস্ত্র বাহিনীর এই রাজনৈতিক শিবির দখল এবং গণতান্ত্রিক রাজনীতির মােড়কে তাদের পােশাক বদল দেশ ও দেশবাসীর জন্যে কতােটা কল্যাণকর হয়েছে, সে বিতর্কে না গিয়েও আজ এটা প্রায় নিশ্চিত করে বলা যায় যে রাজনীতিতে তাদের দৃঢ় অবস্থান সব বুঝেশুনেই দেশবাসী এতদিনে অনেকটা আত্মন্থ করে নিয়েছে। খুব সম্ভব তাদের বিবেচনায় রাজনীতিতে কিংবা রাষ্ট্রক্ষমতায় সামরিক বাহিনীর বেসামরিক উপস্থিতি মােটেও অপাঙক্তেয় নয়, অনাহূত তাে নয়ই। কিভাবে এটা সম্ভব হলাে এবং কেনই বা হলাে সে আত্মজিজ্ঞাসামূলক চিন্তা থেকেই গ্রন্থকার মেজর নাসির উদ্দিন তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, সম্পৃক্ততা এবং পরােক্ষ অন্বেষণের মধ্যদিয়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথযাত্রায় সশস্ত্র বাহিনীর উত্থানের ঘটনাপ্রবাহ পক্ষপাতহীন বিবেচনায় বিবৃত করার চেষ্টা করেছেন। তার এই প্রয়াসেরই সারসংকলন ‘বাংলাদেশ: বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর'।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ট্যাংক কোরের সাবেক অফিসার মেজর নাসির উদ্দিন স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন সক্রিয় সৈনিক। ১৯৭০-এর মার্চে তিনি কমিশনপ্রাপ্ত হন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতেও তিনি ট্যাংক কোরে চাকরি করেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তিনি রংপুরে ২৯ ক্যাভেলরি রেজিমেন্টে থাকাকালীন অন্তরীণ হন এবং পরবর্তীতে অন্তরীণ অবস্থা থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পূর্ব রণাঙ্গনে পদাতিক বাহিনীর (২ ইস্ট বেঙ্গল) একটি নিয়মিত কোম্পানির নেতৃত্ব দেন। এরপর ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সৃষ্টির যে প্রক্রিয়া শুরু হয় তাতেও তিনি সক্রিয় ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বে তিনি ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের 'ডি' কোম্পানির নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। এরপর হরষপুর, চান্দুরা, শাহবাজপুর, সরাইল, দুর্গাপুর ও আশুগঞ্জের যুদ্ধে তিনি সফল নেতৃত্ব দেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম ট্যাংক রেজিমেন্ট বেঙ্গল লান্সার তার নেতৃত্বেই গড়ে ওঠে এবং তিনিই এই রেজিমেন্টের প্রথম অধিনায়ক নিযুক্ত হন। ৩ নভেম্বর '৭৫-এ মেজর জেনারেল খালেদ মােশাররফের নেতৃত্বে যে অভ্যুত্থান সংঘঠিত হয়, তিনি ছিলেন তার অন্যতম সংগঠক ৭ নভেম্বর '৭৫-এ অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে তিনি অন্তরীণ হন এবং পরবর্তী বছরের মাঝামাঝি সময় নাটকীয় এক অবস্থার মধ্যদিয়ে তার কারামুক্তি ঘটে। সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পর অন্যান্য কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি তিনি লেখালেখির সঙ্গে জড়িয়ে যান। তিনি ইতিমধ্যে দেশের একজন অগ্রসর কলামিস্ট হিসেবে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছেন। তার এই লেখালেখির ব্যাপক পরিসর জুড়ে আছে মুক্তিযুদ্ধ । আর এই পরিসরের উল্লেখযােগ্য একটি কাজ হচ্ছে ‘যুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধীনতা।