নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মা মানুষকে প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করতেন। প্রকৃতিকে জয় করা নয়, তাকে ভালোবেসে তার অংশ হয়ে স্নিগ্ধ সুন্দর জীবন যাপনের দিকে তিনি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছেন। তাঁর খুব প্রিয় একটা বই ছিল ফরাসি লেখক অতোয়ান দো সাঁৎ একঝুপেরির ছোট রাজকুমার; এ বইয়ের মূল বাণী ভালোবাসা। মানুষ ও প্রকৃতির জন্য গভীর ভালোবাসা ছিল বলেই দ্বিজেন শর্মা হয়ে উঠেছিলেন সুন্দর মনের অধিকারী একজন অসাধারণ মানুষ। অবিভক্ত ভারতের আসাম রাজ্যের মৌলভীবাজারে তাঁর জন্ম। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলন, দেশবিভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ব্যাপক দেশান্তর, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, আইয়ুব খানের সামরিক শাসন, বাষট্টির ছাত্র আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের জলোচ্ছ্বাস, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, সোভিয়েত সমাজতন্ত্র, গ্লাসনস্ত-পিরিস্ত্রোইকা ও সমাজতন্ত্রের পতন এবং একুশ শতকের বাংলাদেশের প্রথম দেড় দশকের রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঘটনাবলির মনোযোগী ও সংবেদনশীল সাক্ষী তিনি। এই সমস্ত কথা নিয়েই লেখা হয়েছে মধুময় পৃথিবীর ধূলি। এ বই শুধু তাঁর আত্মজীবনী নয়, তাঁর দেখা দেশ-কাল-মানুষের এক আন্তরিত আখ্যানও বটে। দ্বিজেন শর্মার দীর্ঘ জীবনের কোনো পর্ব ছিল আশায় উজ্জ্বল, কোনো পর্ব আশাভঙ্গের বেদনায় মলিন; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি ছিলেন আশাবাদী মানুষ। এক অনিঃশেষ শুভবোধে প্রশান্ত ছিল তাঁর মন। এই পৃথিবীর সবকিছুই তাঁর কাছে ছিল মধুময়।
দ্বিজেন শর্মার জন্ম ২৯ মে ১৯২৯ সালে, মৌলভীবাজার জেলার শিমুলিয়া গ্রামে। পিতা চন্দ্ৰকান্ত শৰ্মা এবং মাতা মগ্নময়ী দেবী। একাধারে নিসর্গবিদ, বৃক্ষপ্রেমিক, অনুবাদক, শিশুসাহিত্যিক, বিজ্ঞানলেখক,গবেষক ও শিক্ষক। উদ্ভিদ, ফুল, পাখি নিয়ে মেতে থেকেছেন সারাটি জীবন। এগুলো নিয়ে বলতে লিখতে পড়তে ভালোবাসেন। ১৯৫৮ সালে উদ্ভিদবিদ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবন শুরু করেছিলেন শিক্ষক হিসেবে। বরিশালের ব্ৰজমোহন কলেজ ওঢাকার নটরডেম কলেজ, সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেন ও বাংলা কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। পরবর্তী সময়ে তিনি অনুবাদকের চাকরি নিয়ে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের মস্কো চলে যান। দীর্ঘকাল কাটিয়েছেন প্রবাসজীবন। সেই সুবাদে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ফিনল্যান্ড ও জার্মানি ভ্ৰমণ করেছেন। সবখানেই বোটানিক গার্ডেন খ্যাত প্রধান-প্রধান পার্ক ও বাগান দেখেছেন আনন্দ ও আগ্রহে। অনেক লিখেছেন বিজ্ঞান, শিক্ষা ও প্রকৃতি বিষয়ে। পেয়েছেন বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার, চট্টগ্রাম বিজ্ঞান পরিষদের ড.কুদরাত-ই-খুদা স্মৃতি স্বর্ণপুরস্কার, এম নুরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কার এবং শিশু একাডেমী পুরস্কারসহ নান পদক ও সম্মাননা।