"আদর্শ হিন্দু হোটেল" বইটির প্রথম ফ্ল্যাপ-এর লেখাঃ জনজীবন সম্বন্ধে তার যে প্রগাঢ় প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা ছিলাে, তা বিভূতিভূষণের ছােটো গল্পগুলি একসঙ্গে পড়লে পাঠকদের কাছে সুস্পষ্টরূপে প্রতিয়মান হয়, বিশেষ করে গ্রামজীবন নিয়ে লেখা তার রচনাগুলি। উপন্যাসে অবশ্যই জনজীবন এসেছে, কিন্তু স্তর-বিভাগে আর আস্বাদ অপেক্ষাকৃত ভিন্ন। সেখানে এক বৃহত্তর পরিবেশ এসে যুক্ত হয়, সংযােগ হয় উন্মক্ত প্রকৃতির। এককথায়, প্রকৃতি ও মানুষে মিলে এক অভূতপূর্ব সাম্য গড়ে ওঠে। মনে হয় তার নিজস্ব ছােটগল্প রচনার যে ধারা তাই যেন বহুলাংশে কাজ করেছে তার আদর্শ হিন্দু হােটেল উপন্যাসটিতে। এখানেই এর স্বাতন্ত্র্য। প্রকৃতিকে ছাড়িয়ে জনজীবনই প্রখর হয়ে দাঁড়িয়েছে, যদিও এটি বাস্তব জীবনের যথাযথ প্রতিচ্ছবি নয়। সাংবাদিকতার সাথে সাহিত্যিকতার তফাৎ এখানেই। আদর্শ হিন্দু হােটেল গ্রন্থটির প্রথম প্রকাশ আশ্বিন ১৩৪৭। গ্রন্থাকারে বার হবার আগে মাতৃভূমি প্রত্রিকায় ধারাবাহিক আকারে এটা প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৪৫-এর মাঘ থেকে ১৩৪৭-এর ভাদ্র পর্যন্ত। এটি বিভূতিভূষণের ষষ্ঠ উপন্যাস। কৌতুকের বিষয়, এটি পড়ে সাধারণের এমন এক বিশ্বাস ছড়িয়ে পড়ে যে বিভূতিভূষণ অবশ্যই কোনাে সময় হােটেলের ব্যবসা করেছিলেন। অনুভূতি অভিজ্ঞতা ও কল্পনা, এই তিন নিয়েই সাহিত্যিকের সৃষ্টিশীলতা প্রকাশ পায়, এজন্যই তাকে দ্বিতীয় বিধাতা বলা হয়।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হৃদয়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, দিনলিপি ইত্যাদি। প্রখ্যাত এই সাহিত্যিক ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল যশোর জেলায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর প্রথম বিভাগে এনট্রান্স ও আইএ পাশ করার মাধ্যমে। এমনকি তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করেন। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো 'পথের পাঁচালী', যা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়ার মাধ্যমে। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই এর মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো 'আরণ্যক', 'অপরাজিত', 'ইছামতি', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল', 'দেবযান' ইত্যাদি উপন্যাস, এবং 'মৌরীফুল', 'কিন্নর দল', 'মেঘমল্লার' ইত্যাদি গল্পসংকলন। ১০ খণ্ডে সমাপ্ত ‘বিভূতি রচনাবলী’ হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র, যেখানে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছে তার যাবতীয় রচনাবলী। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর বিহারের ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর 'রবীন্দ্র পুরস্কারে' ভূষিত হন।