"মহাকাল" বইটির প্রথম ফ্ল্যাপ-এর লেখাঃ স্বর্গছেঁড়া নামের একটি চা-বাগানের পটভূমিতে ‘উত্তরাধিকার’ উপন্যাসের কাহিনির সূত্রপাত। এর নায়ক অনিমেষ কৈশাের পেরিয়ে ধীরে ধীরে নিজের সম্পর্কে দেশের সম্পর্কে, পুরােনাে নীতি-বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধা-ভালবাসার সঙ্গে নতুন করে পরিচয় পেতে শুরু করে। ছাত্র-রাজনীতি অনিমেষকে নিয়ে যায় জটিল আবর্তে। দেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানাের দুর্বার বাসনায় বিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির পতাকার নিচে গিয়ে দাঁড়াল অনিমেষ। কিন্তু মনুষ্যত্ব এবং মানবিক মূল্যবােধ তাকে সরিয়ে নিয়ে এল উগ্র রাজনীতিতে। উত্তাল আগুনে ঝাঁপ দিয়ে নিজেকে দগ্ধ করে সে দেখল, দাহ্যবস্তুর কোনও সৃষ্টিশীল ক্ষমতা নেই। দেশ গড়ার জন্যে বিপ্লবের নিস্ফল হতাশায় ডুবে যেতে যেতে অনিমেষ আবিষ্কার করেছিল বিপ্লবের আর এক নাম মাধবীলতা; যে নারী কিনা কোনদিন রাজনীতি করেনি, শুধু তাকে ভালবেসে আলােকস্তম্ভের মতাে একা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। খরতপ্ত মধ্যাহ্নে যে এক গ্লাস শীতল পানীয়ের চেয়ে বেশি কিছু হতে চায়নি। সেই তাকে নিয়ে শুরু হয় অনিমেষের নতুন জীবন। এই কাহিনি শেষপর্যন্ত কিশাের থেকে তরুণ অনিমেষের আত্ম-অনুসন্ধানের কাহিনি, সেই সাথে আত্ম-জিজ্ঞাসারও কাহিনি। উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’, কালপুরুষ’, ‘মৌষলকাল’ যা ধারণ করে আছে পশ্চিমবঙ্গের অনতি-অতীতকালের রাজনৈতিকসামাজিক সময়-প্রবাহ। রাজনৈতিক পালাবদলের সেই ইতিহাসের নানান বাঁকে উপস্থিত যুবক অর্ক, যে অনিমেষের সন্তান। স্বভাবেপ্রতিবাদে, আবেগে-ভালবাসায় অর্ক যেন এক অবাধ্য স্বর। মৌষলপর্বের পারস্পরিক অবিশ্বাসের দিনকালেও প্রৌঢ় অনিমেষমাধবীলতা ঝলসে ওঠে আরও একবার। কেউ বিপ্লব-বিশ্বাসে, কেউ-বা জীবন-বিশ্বাসে। নিরপরাধ অনিমেষকে পুলিশের হাত থেকে মুক্ত করার প্রশ্নে মাধবীলতা যখন দৃঢ়তার সাথে মাথা নিচু না করার প্রত্যয় ঘােষণা করে তখন মাধবীলতার উদ্দেশে আমাদেরও হাত দুটি উপরে উঠে যায়। পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গের অগ্নিস্রাবী রাজনৈতিক পথ-পরিক্রমার শেষ পর্বে অনিমেষ আশা করেছিল তার পুত্র অর্ক তার সমাজতান্ত্রিক আদর্শের নিশানটি শক্ত হাতে বহন করে নিয়ে চলবে; যেহেতু তার রক্তের মধ্যে ছিল পিতা অনিমেষের সুস্থ আদর্শবাদ এবং তার মা মাধবীলতার দৃঢ়তা ও পবিত্রতার সংমিশ্রিত উপাদান। এক ভিন্ন মানসিকতায় সে আহ্বান শুনেছিল চিরকালীন মানবতার। এটি মূলত অনিমেষের কাহিনি- যার উত্তরাধিকার ছড়িয়ে যায় একমাত্র সন্তান অর্কের ভেতর। সমকালের তরুণসমাজের জীবন-জিজ্ঞাসাকে মূর্ত করে তােলার দৃষ্টান্ত সমরেশের মতাে আর কারও নেই। এই উপন্যাস চতুষ্টয়ের সমাহার ‘মহাকাল’-এর ভেতর দিয়ে তিনি তার সমকালকে, বাঙালির আটপৌরে জনজীবনের চালচিত্রকে এতটাই জীবন্ত করে তুলেছেন যা অনন্য এবং তুলনারহিত। ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, “অনিমেষের মতাে মানুষ বিরল- তবু আছে। সে নিজেকে ক্রমাগত প্রশ্ন করে চলেছে, কোনটা ঠিক, কোনটা সত্য, কোনটা মঙ্গলজনক। এমন মানুষ আছে বলেই মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানাে যায় না।”
১৯৪২ সালের ১০ই মার্চ পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে জন্ম বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক এবং ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদারের। তাঁর শৈশব কাটে প্রকৃতির কোলে, চা বাগানে ঘুরে, আদিবাসী শিশুদের সাথে খেলে। এ কারণেই সমরেশ মজুমদার এর বই সমগ্রতে বারবার উঠে আসে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি, চা বাগান, বৃষ্টি কিংবা পাহাড়ের কথা। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় জলপাইগুড়ির জেলা স্কুল থেকে। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি কলকাতা স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। গ্রুপ থিয়েটারের প্রতি তাঁর ছিল ভীষণ ঝোঁক। মঞ্চনাটকে চিত্রায়নের উদ্দেশ্যে তিনি সর্বপ্রথম ‘অন্তর আত্মা’ নামের একটি গল্প রচনা করেছিলেন। সেই গল্পে নাটক মঞ্চায়িত না হলেও পশ্চিমবঙ্গের পাক্ষিক সাহিত্য পত্রিকা দেশ-এ প্রকাশিত হয় গল্পটি। সেই থেকেই শুরু তাঁর লেখকজীবন। সমরেশ মজুমদার এর বই বাংলাদেশের প্রচুর মানুষ পড়েন, পড়তে ভালোবাসেন। দুই বাংলাতেই তিনি সমান জনপ্রিয়। তিনি ঔপন্যাসিক হিসেবে বিখ্যাত হলেও, ছোটগল্প, কিশোর উপন্যাস, নাটক, চিত্রনাট্যসহ, গোয়েন্দাকাহিনীও রচনা করেছেন। সমরেশ মজুমদার এর বই সমূহ, যেমন- সাতকাহন, গর্ভধারিণী, মৌষকাল, ট্রিলজি- উত্তরাধিকার-কালবেলা-কালপুরুষ, আট কুঠুরি নয় দরজা ইত্যাদি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তাঁর সৃষ্ট চরিত্র অনিমেষ, মাধবীলতা, দীপাবলী আর জয়িতা পাঠকমনে আজও বিরাজমান। সাহিত্যে তাঁর অনন্য এবং অসামান্য অবদানের জন্য তিনি বিভিন্ন সময়ে আনন্দ পুরস্কার, সত্য আকাদেমী পুরষ্কার, বঙ্কিম পুরস্কার এবং আইআইএমএস পুরস্কার অর্জন করেছেন।