"আখ্যান ১৯৭১" ফ্ল্যাপে লেখা কথা: ...প্রথম ব্যাচে যারা গিয়েছিল, তারা আগস্ট মাসের প্রথম দিনে হঠাৎ করে যুব-শিবিরটায় এসে সকলকে চমকে দিল। তাদেরকে চমকে দিয়ে কিছুক্ষণ পর অঝাের বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সেখান থেকে আরও সরজন চলে গেলে কাঙ্ক্ষিত মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা প্রশিক্ষণ গ্রহণের উদ্দেশ্যে। যারা যেতে পারল না তারা আফসােসে ভরে উঠল। কারও চোখে শ্রাবনের ঢল নেমে এল। অনেক মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশিক্ষণ প্রাপ্তদের থেকে যুদ্ধের প্রয়ােজনীয় তালিম নিতে ব্যাকুল হয়ে গেল। অনেকে প্রশিক্ষণ ছাড়াই তাদের সাথে দেশের ভেতরে প্রবেশের ইচ্ছা প্রকাশ করল। কারণ যুব-শিবিরের অবস্থা তখন পাকি-মিলিটারীর ভয়ের চেয়ে কোনাে অংশে কম নয়। তারা একই অবস্থা দেখে আসছে দীর্ঘদিন ধরে এবং তার কোনাে পরিবর্তের চিহ্ন দেখতে পায়নি! ভয়ানক বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আকাশে সর্বদা কালাে মেঘের ঘনঘটা। নদীর পানির রঙ যেমন বদলেছে; তেমনি তার স্রোতের তুখােড়তাও বৃদ্ধি পেয়েছে। রহমান শরণার্থী-ক্যাম্পের অবস্থা জানতে গিয়ে দেখতে পায়, আগের সেই নদীটা দুকূল ছাপিয়ে ক্যাম্পের মধ্যে চলে এসেছে। যেন তারও থাকার মতাে কোনাে আশ্রয় নেই! কালিগঙ্গা ঘােলাস্রোত নিয়ে তুখােরভাবে ছুটে চলে, সাপের মতাে পাক খায়। কুণ্ডলি পাকায়। তাতে ভেসে চলে দূরবর্তী শহরের যতােসব আবর্জনা, জঞ্জাল আর মরামারীতে মৃত শরণার্থীর ফোলাপচা গলিত প্রায় লাশ! স্বাধীনতার জন্য ইতােপূর্বে এতাে আত্মহুতি কী দিতে হয়েছে কোনাে জাতির, ব্যাপারটা আকস্মিকভাবেই যেন ভাবিয়ে তােলে রহমানকে। দেশের ভেতরের প্রত্যেকটি বসতীতে মিলিটারি হামলা চালাচ্ছে তাদের দোসর, আলবদর-রাজাকার বাহিনীর সাহায্যে। তারা খোঁজখবর নিয়ে বিশেষ-বিশেষ গ্রাম রাতের আঁধারে ঘিরে ফেলছে। তারপর দিনের আলােয় সেখানকার প্রত্যেকটি যুবক ছেলেকে ধরে নিয়ে গিয়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে হত্যা করছে। নারীদের লাঞ্ছিত করছে। সর্বশেষ তাদের সম্পদ লুট করে ঘরবাড়ি আগুনে পুড়িয়ে তাদের উচ্ছেদ অভিযান অব্যাহত রাখছে। সেখানকার ডােবানালায় অগনিত মানুষের লাশ ভাসছে। প্রত্যেক মুহুতেই সেখানে এক বা একাধিক হত্যাকাণ্ড ঘটছে...।
মুক্তিযুদ্ধের লেখক-গবেষক হিসাবে সুপরিচিত ঔপন্যাসিক সাইদ হাসান দারা-কে একজন। বহুমাত্রিক লেখক হিসাবে আখ্যায়িত করলে খুব একটা ভুল হবে না। তিনি বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রচনা করেছেন অসংখ্য নজরকাড়া আলােচিত উপন্যাস-আখ্যানউপাখ্যান এবং গবেষণাধর্মী গ্রন্থ। পাশাপাশি তিনি ৯০ দশকের পুরােটা সময় জুড়ে দেশ-বিদেশের প্রচারবহুল জাতীয় দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক পত্রিকাসহ দেশ বিদেশের অগণিত লিটিল ম্যাগাজিনে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নানাবিধ প্রবন্ধও লিখেছেন। এবং স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন একজন। ব্যতিক্রমী চিন্তার লেখক-ঔপন্যাসিক হিসেবে। তিনি সর্বদাই একজন নিভৃতচারী লেখক; নিবিড় পরিচর্যায় মননী। গড়ে উঠেছেন নিজস্ব চিন্তায় এবং সর্বদা শিক্ষা নিয়েছেন প্রকৃতির পাঠশালা থেকে। সৃজনশীলতা ও মননশীলতা তার অস্থিমজ্জায়-ইত্যকার প্রমাণ মিলবে তার সকল গ্রন্থে। তিনি ১৯৬৩ সালের ১০ আগস্ট পাবনা শহরের উপকণ্ঠে ছাতিয়ানী গ্রামের এক। সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।