"সাম্প্রতিক বিবেচনা : বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস" বইয়ের ভূমিকার লেখা: সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে জাতীয় মধ্যশ্রেণীভুক্ত বুদ্ধিজীবীরা সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতা এই রাষ্ট্রীয় চতুস্তম্ভের জয়ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত করে ফেলেছিলেন। রেডিও টেলিভিশনে তােষামােদ, চাটুকারিতা, নির্লজ্জ আত্মপ্রচার মানুষের সুস্থ কাণ্ডজ্ঞানকে একরকম মুছে ফেলতে উদ্যত হয়েছিল। সন্ত্রাস, গুম, খুন, ছিনতাই, দস্যুতা, মুনাফাখখারি, কালােবাজারি, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্বিচার হত্যা এগুলাে একান্তই নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মানুষের হনন প্রবৃত্তি, লােভ রিরংসার এরকম নির্লজ্জ আত্মপ্রকাশের সিংহদুয়ার খুলে দেয়ার ব্যাপারে তৎকালীন সরকার মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল। এই ধরনের একটি মাৎস্যন্যায় পরিস্থিতিতে বুদ্ধিজীবীদের অবশ্যই একটি পালনীয় ভূমিকা ছিল, একটা দায়িত্ব ছিল। কিন্তু তারা সেদিন তাদের ওপর আরােপিত দায়িত্ব-কর্তব্য বিস্মৃত হয়ে যাবতীয় অমানবিক কর্মকাণ্ডে সরকারের মদদ দিয়ে নিজেদের আখের গুছাবার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। | স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সামগ্রিক পরিস্থিতির এরকম অবনতির বহুবিধ। গভীরতর কারণ নিশ্চয়ই বর্তমান ছিল এবং সেগুলাের উৎসও ছিল জাতীয় রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতির ধারাবাহিক ইতিহাসের গভীরে প্রােথিত। আমি চারদিকে যা ঘটছে ভােলা চোখে দেখে প্রতিক্রিয়াগ্রস্ত হয়ে আমার শঙ্কা, সন্দেহ এবং ক্ষোভের অভিব্যক্তি ছাপার হরফে প্রকাশ করেছিলাম। আমি যা লিখেছিলাম, তার একটা বাক্যও আমাকে গবেষণা করে আবিষ্কার করতে হয়নি। আমার চারপাশে যা ঘটছে। তা দেখে চারপাশের মানুষের মুখের কথা শুনে আমার বয়ানটুকু তৈরি করেছিলাম।
বাঙালি মুসলিম লেখকদের মধ্যে অন্যতম কীর্তিমান কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফা একাধারে ছিলেন কবি, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক, গণবুদ্ধিজীবী ও চিন্তাবিদ। বাবা-মায়ের দ্বিতীয় সন্তান আহমদ ছফা জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৩ সালের ৩০ জুন, চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া গ্রামে। নিজ এলাকায় তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়, এবং ১৯৫৭ সালে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত হন এবং মাস্টারদা সূর্যসেনের আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হলেও সেখানে পড়ালেখা শেষ করেননি, এবং জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের অধীনে পিএইচডি শুরু করলেও তা আর শেষ করা হয়ে ওঠেনি। আহমদ ছফা এর বই সমূহ বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পাঠকদের মধ্যে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বই হিসেবে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা প্রবন্ধগ্রন্থ ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’। আহমদ ছফা এর বই সমূহের মাঝে 'ওঙ্কার', 'অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী', 'বাঙালি মুসলমানের মন', যদ্যপি আমার গুরু', 'গাভী বিত্তান্ত' প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য কীর্তি হলো জার্মান সাহিত্যিক গ্যাটের অমর সাহিত্যকর্ম 'ফাউস্ট' বাংলায় অনুবাদ করা। আহমদ ছফা এর বই সমগ্র একত্রিত করে রচনাবলি আকারে ৯টি খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানবিরোধী এই সাহিত্যিক 'লেখক শিবির পুরস্কার' ও বাংলা একাডেমির ‘সাদত আলী আখন্দ পুরস্কার’ পেলেও সেগুলো গ্রহণ করেননি। এই পাঠকনন্দিত সাহিত্যিক ২০০১ সালের ২৮ জুলাই ৫৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক মরণোত্তর 'একুশে পদকে' ভূষিত হন।