ছাত্র থাকার সময়ে আমি ইংরেজিতে লিটারারি আইডিয়ালস ইন বেঙ্গল’ শিরােনামে একটা প্রবন্ধ লিখি। সেই রচনাটি বাংলা একাডেমীর ইংরেজি জার্নালে প্রকাশিতও হয়েছিল। উনিশ শ’ আটষট্টি-উনসত্তর সালের দিকে হবে। সেই সময়েই আমার প্রবন্ধের বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অংশ লিখতে গিয়ে মনে স্বতঃই কতিপয় প্রশ্ন জেগেছিল । তারপর থেকেই বঙ্কিম সম্পর্কে আমি সচেতনভাবে অনুসন্ধানের মাধ্যমে আমার প্রশ্নগুলাের জবাব খুঁজতে থাকি। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ওপর লিখিত যতগুলাে গ্রন্থ, পত্র-পত্রিকা এবং জার্নালে প্রকাশিত রচনা আমার হাতে এসেছে, আগ্রহসহকারে পাঠ করতে আরম্ভ করি। বঙ্কিম সম্পর্কে যে বিতর্ক দীর্ঘকাল থেকে চলে । আসছিল, রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত তাতে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে পারেননি। তারপর সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রশ্নের জটসমূহ যখন ক্রমবর্ধিত হারে জটিল আকার ধারণ করতে থাকে, বঙ্কিম সম্পর্কিত বিতর্কও নতুন নতুন মাত্রা অর্জন করতে থাকে। আমাদের দেশে সাম্প্রতিককালে বঙ্কিম সম্পর্কিত বিতর্ক যেখানে এসে থেমেছে, সেটাকে বিচার বলা বােধকরি সঙ্গত হবে না। একদল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে রবীন্দ্রনাথেরও ওপরে স্থান দিতে চান, অন্যদল তাঁকে একেবারে খারিজ করতে পারলে বেঁচে যান। আমার এই রচনাটিতে পূর্বতন বিতর্কসমূহের যে ধারাবাহিকতা তার রেশ একেবারে অনুপস্থিত সেকথা আমি বলতে পারব না। বরঞ্চ বলতে চাই বিতর্কটা চলে আসছিল বলেই আমি রচনাটি লেখার দায়িত্ব স্বীকার করতে প্রলুব্ধ হয়েছি। এই রচনা আমি প্রত্যক্ষভাবে কোন ব্যক্তি বা মহল বিশেষের পক্ষে বা বিপক্ষে সমর্থন অসমর্থন জানানাের জন্য লিখতে প্রবৃত্ত হইনি। বিগত পঁচিশ বছর সময়ের পরিধিতে যেসকল চিন্তা আমার মনে সঞ্চিত হয়েছে, সেগুলাে একটা সূত্রাকারে প্রকাশ করার জন্যই এ লেখা। অন্যান্য কাজের চাপের মধ্যে লেখার কাজটি করতে হয়েছিল বলে মাঝে মাঝে পুনরুক্তি দোষ ঘটেছে। আমার লেখাটিকে সঠিক অর্থে গবেষণা-কর্ম বলা শােভন হবে না। আগামীতে যারা গবেষণা করবেন, আমি আশা করি তাদের সামনে এই রচনাটি কতিপয় নতুন দিক উন্মােচন করবে এবং সেটাই হবে এই রচনার সার্থকতা ।
বাঙালি মুসলিম লেখকদের মধ্যে অন্যতম কীর্তিমান কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফা একাধারে ছিলেন কবি, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক, গণবুদ্ধিজীবী ও চিন্তাবিদ। বাবা-মায়ের দ্বিতীয় সন্তান আহমদ ছফা জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৩ সালের ৩০ জুন, চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া গ্রামে। নিজ এলাকায় তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়, এবং ১৯৫৭ সালে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত হন এবং মাস্টারদা সূর্যসেনের আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হলেও সেখানে পড়ালেখা শেষ করেননি, এবং জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের অধীনে পিএইচডি শুরু করলেও তা আর শেষ করা হয়ে ওঠেনি। আহমদ ছফা এর বই সমূহ বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পাঠকদের মধ্যে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বই হিসেবে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা প্রবন্ধগ্রন্থ ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’। আহমদ ছফা এর বই সমূহের মাঝে 'ওঙ্কার', 'অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী', 'বাঙালি মুসলমানের মন', যদ্যপি আমার গুরু', 'গাভী বিত্তান্ত' প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য কীর্তি হলো জার্মান সাহিত্যিক গ্যাটের অমর সাহিত্যকর্ম 'ফাউস্ট' বাংলায় অনুবাদ করা। আহমদ ছফা এর বই সমগ্র একত্রিত করে রচনাবলি আকারে ৯টি খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানবিরোধী এই সাহিত্যিক 'লেখক শিবির পুরস্কার' ও বাংলা একাডেমির ‘সাদত আলী আখন্দ পুরস্কার’ পেলেও সেগুলো গ্রহণ করেননি। এই পাঠকনন্দিত সাহিত্যিক ২০০১ সালের ২৮ জুলাই ৫৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক মরণোত্তর 'একুশে পদকে' ভূষিত হন।