"শব্দ হয় শব্দের ঘরে" বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা: মানব-ভাষা কী, তা কে না জানে! অথচ ‘সকলের জানা’ সাধারণ এ বিষয়টি নিয়ে আহমেদ শামীমের মুগ্ধতা ও বিস্ময়ের শেষ নেই। সরল, অথচ ভাবতে গেলে কূল-কিনারা পাওয়া যায় না এমন নানান বিষয়ে লেখকের বিস্ময়ের ফল শব্দ হয় শব্দের ঘরে' গ্রন্থটি। ভাষাকে কেন্দ্রে রেখে রাজনীতি-ধর্ম-দর্শন-সাহিত্য-সমাজনীতি বিষয়ে তত্ত্বগত অথচ সরস ও নির্ভার আলােচনা এই গ্রন্থে রয়েছে। এতকাল কাউকে আমরা যা বলেছি, তা যে ভাষা ছিল না, কথা ছিল—এতদিন পর তা বুঝতে পারা গেল। আর আমাদের মনের কথা ‘ভাষা’, ‘কথা’ নয়। অথচ এতকাল প্রথাগত ব্যাকরণ আমাদের ভাষার সঙ্গে কী অনায়াসে সামাজিক প্রয়ােজনকে সম্পৃক্ত করে রেখেছিল। আধুনিক ভাষাবিজ্ঞান স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, ভাষা উৎপদান মানুষের সচেতন ইচ্ছা-নিরপেক্ষ। ভাষা হিসেবে মনে মনে যা পল্লবিত হয়ে ওঠে, তার নেপথ্যের বাসনাও স্বয়ংক্রিয়। আর ভাষার মূল অঙ্গ একটি জেনারেটর, যেটা পদক্রমিকবিন্যাস তৈরি করে, এবং মনােগত অভিধান থেকে শব্দ নিয়ে থাকে, এবং বাক্যতাত্ত্বিক নিয়মও সে মানে। মানব ভাষা মূলত কী? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজছে ভাষাতত্ত্ব আজ প্রায় তিন হাজার বছর ধরে। আধুনিক ভাষাবিজ্ঞান মতে, যা বলে আমরা মনের ভাব প্রকাশ করি তা ভাষা নয় বুলি। বুলি ভাষারই জাতজিনিস। তাহলে, ভাষা কি নিজেই ভাব?– না, তাও নয়। ভাষা তথা মানব ভাষা হলাে ভাব উৎপাদনের একটি ব্যবস্থা। জীবের ভাব উৎপাদনের ব্যবস্থা আরও আছে তবে এই ব্যবস্থাটি মানবেই বিদ্যমান, এবং মানবের অন্যান্য ব্যবস্থার সাপেক্ষে এটা অনুপম। চমস্কি এবং তাঁর সঞ্জননী ব্যাকরণশাস্ত্র আমাদের ভাষার স্বরূপ সম্পর্কে নতুন ধারণা দেন, নতুন সংজ্ঞার্থ দেন। এই গ্রন্থে লেখক আধুনিক ভাষাতত্ত্বের ভাষা দর্শনের উপস্থাপিত ভাষার স্বরূপের সঙ্গে লালন দর্শনে ভাষার স্বরূপের একটি তুলনামূলক আলােচনা করে শব্দ হয় শব্দের ঘরে বইটি আরম্ভ করেন। ভাষার স্বরূপ আলােচনা শেষে লেখক চলে যান ভাষার বহিঃরূপ আলােচনায়। একটি বহু ভাষাভাষীর রাষ্ট্রে ভাষা মতাদর্শ নির্ণয় সে রাষ্ট্রের ভাষানীতি গ্রহণের পূর্বশর্ত। সে জন্য ভাষানীতির তত্ত্বীয় দিক এবং উপমহাদেশীয় অভিজ্ঞার সাপেক্ষে একটি গণতান্ত্রিক ভাষানীতি রূপরেখার ধারণা তৈরিতে দুইটি প্রবন্ধ ব্যয় করেন। ভাষা পরিকল্পনার খাতিরে ভাষার বর্ণনাত্মক ব্যাকরণ প্রণয়ন জরুরি হয়ে পড়ে। সে কারণে লেখক বাংলা ভাষার বর্ণনাত্মক ব্যাকরণ প্রণয়নের প্রয়াস নিয়ে পর্যালােচনা হাজির করেছেন একটি প্রবন্ধে। এরপর, লেখক কয়েকটি প্রবন্ধে শব্দের ধ্বনিগত ও অর্থগত বিবর্তন এবং তার সঙ্গে সামাজিক মূল্যের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করেন। পরিশেষে, ভাষাতাত্ত্বিক অভিজ্ঞান প্রয়ােগে সাহিত্যকর্ম পর্যালােচনার উদাহরণ হাজির করেন কয়েকটি প্রবন্ধে। তার মধ্যে জীবনানন্দের কবিতায় তার কর্তাস্বরূপের একটি বিশেষ মাত্রা উদঘাটন এবং ফরহাদ মজহারকৃত আহমদ ছফার উপন্যাস ও রাজনৈতিক দর্শন মূল্যায়নের একটি পর্যালােচনামূলক বিচার উপস্থাপন অন্যতম। নির্যাসের মতাে সুসংবদ্ধ এ গ্রন্থটি নতুন গবেষকের চিন্তাকে উসকে দেবে। গ্রন্থভুক্ত প্রবন্ধগুলাের উপস্থাপিত ধারণাগুলাে পাঠকের মনে ও কাজে মহীরূহ হবে, এই বিশ্বাস রাখি। -অভী চৌধুরী