"নির্বাচিত গল্প" ফ্ল্যাপে লেখা কথা: সাতচল্লিশপূর্ব ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কাল, ষাটের দশকের নব্য ঔপনিবেশিক কাল, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা-পরবর্তী বাঙালি জীবন, '৯০-এর গণঅভ্যুত্থান, বিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তিযুগসহ দীর্ঘ পাঁচ দশকের বাঙালি জীবন তাঁর উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে তেমনি গল্পে আদিবাসী মানুষের জীবন-দ্রোহ, সংস্কৃতি ও নগরজীবনের কেদাক্তরূপ : প্রেম-কাম অন্তৰ্জীবন ও বহির্জগতের বিবিধরূপ তার গল্পের বিষয় হয়েছে। তিনি অত্যন্ত সূক্ষ্ণভাবে জীবনকে পর্যবেক্ষণে করেন, দক্ষ এবং নিবিড় আন্তরিকতায়, নির্মোহ দৃষ্টিতে কথাশিল্পের মানবমানবীকে সৃজন করেন। সময় ও সমাজবাস্তবতার নিরিখে বাঙালি জীবনের প্রদোষকাল থেকে আধুনিককাল পরিসরের যাপিতজীবন, বেঁচে থাকার নিরন্তর লড়াই, রাজপ্রশাসনের শােষণপীড়ন, কৃষিজীবী তণমূল মানুষের অধিকার-সংগ্রাম নাগরিক জীবনের বিকলাঙ্গরূপ এবং গ্রামীণ জীবনের অভাজনের জীবনমথিত কান্না প্রভৃতি চিত্রিত হয়েছে তার কথাসাহিত্যে। পল্লীর নিম্নবর্গ নিরন্ন মানুষই শুধু নয়, নাগরিক জীবন, ইতিহাস, আধুনিক প্রযুক্তির অভিঘাত, ঐতিহ্যের কথাও তাঁর শাণিত কলমে শিল্পরূপ লাভ করেছে। সামগ্রিক মানব প্রেমের জীবনের জয়গাঁথা বর্ণনার পাশাপাশি মধ্যবিত্তের দালাল চরিত্রের মুখােশ উন্মোচন করেছেন দৃঢ় সাহসিকতায়। জীবনের গভীর থেকে গভীরতর স্তরে প্রবেশ করে জীবনকে তিনি নিরীক্ষা করেছেন দক্ষ-বীক্ষণে এবং সামগ্রিক জীবনকে নিয়ে নির্মাণ করেছেন তাঁর কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রভূমি।
শওকত আলীর (জন্ম: ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬ - ২৫ জানুয়ারি, ২০১৮)। জন্মস্থান পশ্চিম বাংলার পশ্চিম দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জ। স্কুলের পড়াশোনা শ্ৰীরামপুর ও রায়গঞ্জে। দেশ-বিভাগের চার বছর পর তাঁর চিকিৎসক পিতা সপরিবারে দিনাজপুর শহরে চলে এলে শওকত আলী সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে কলেজ শিক্ষকতায় নিয়োজিত হন। ঢাকার জগন্নাথ কলেজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে দীর্ঘ পাঁচিশ বছর অধ্যাপনা করার পর বর্তমানে তিনি সরকারী সংগীত মহাবিদ্যালয়ে অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত। একটি ছোট উপন্যাস ‘পিঙ্গল আকাশ” (১৯৬৪) তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই। এর পর প্রকাশিত হয়েছে। দুটি ছােটগল্প সংকলন ও একটি উপন্যাস। শিশুকিশোরদের জন্যেও তিনি লিখে থাকেন। বাংলা ছোটগল্পে বিশেষ অবদান রাখার জন্য শওকত আলী বাঙলা একাডেমি পুরস্কার পান ১৯৬৮ সালে। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ লেখক শিবির তাঁকে হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার প্রদান করে। এ ছাড়াও তাঁকে ১৯৮৩ সালে অজিত গুহ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৬ সালে ফিলিপূস সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৯ সালে আলাওল সাহিত্য পুরস্কার এবং ১৯৯০ সালে রাষ্টিয় পুরস্কার ২১শের পদকে ভূষিত করা হয়। নৃতত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাসে তাঁর আগ্ৰহ অত্যন্ত গভীর। বাংলার প্রায়—লুপ্ত ও ঝাপসা ইতিহাসে তাঁর সৃজনশী অনুসন্ধান আমাদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করেছে।