"তিথিডোর "বইটির ১ম ফ্লাপের কিছু কথা: প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে পৃথিবীব্যাপ্ত সামাজিক অবক্ষয়, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, মূল্যবােধ বিচ্যুতি, মানবিক-সম্ভাবনায় অবিশ্বাস এবং পােডােজমিতে ফাঁপা মানুষের বিপন্ন অস্তিত্বের প্রতিবেশে বাংলা সাহিত্যে বুদ্ধদেব বসুর (১৯০৮-১৯৭৪) দীপ্র আবির্ভাব। কবি হিসেবে সমধিক পরিচিতি হলেও, সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তাঁর প্রতিভার ছোঁয়া লেগেছে। বাংলা সাহিত্যের বিকাশের ধারায় ঔপন্যাসিক হিসেবেও তিনি রেখেছেন তাঁর প্রাতিস্বিকতার স্বাক্ষর। তার ঔপন্যাসিক-প্রতিভার এক উজ্জ্বল প্রকাশ তিথিডাের (১৯৪৯)। বিষয়াংশ, মৌল-জীবনার্থ এবং প্রকরণ-স্বাতন্ত্রের দৃষ্টিকোণে তিথিডাের বাংলা উপন্যাসের ধারায় প্রকৃত অর্থেই এক স্মরণীয় নির্মাণ। আলােচ্য উপন্যাসে আমরা বুদ্ধদেব বসুর বাস্তব-জীবনপ্রীতি ও পরিবার-সংলগ্নতার পরিচয় পাই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন পরিবর্তমুখী সমাজমানসের প্রেক্ষাপটে রচিত হয়েছে এ-উপন্যাস। সত্যেন ও স্বাতীর প্রেম-আখ্যানের অন্তরালে এখানে প্রতিভাসিত হয়েছে চল্লিশের দশকের বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সমাজজীবনের নানামাত্রিক চিত্র। বুদ্ধবেদ বসু মূলত চরিত্রের অন্তঃবাস্তবতার রূপকার; কিন্তু তিথিডাের উপন্যাসে, অন্তঃবাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গে তিনি জীবনের বহিরঙ্গ রূপকেও শিল্পিত করেছেন। জীবনের এই বহিরঙ্গ রূপকে ধরতে গিয়েই তিথিডাের হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাওয়া একটি বিশেষ কালের শৈল্পিক দলিল। তিথিডাের উপন্যাসে একান্নবর্তী পরিবারজীবনের প্রীতিস্নিগ্ধ সম্পর্কের স্পর্শ আছে, আছে জীবনের প্রসন্নপ্রান্তরের হাতছানি। তবে একই সঙ্গে বিপ্রতীপ একটি প্রবণতাও এ-উপন্যাসের অন্তস্রোতে প্রবহমান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন এবং যুদ্ধোত্তর বিপন্ন-বিচূর্ণ সময় দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে তিথিডাের উপন্যাসের প্রধান সব চরিত্র। স্বৈরবৃত্ত-কালের অমােঘ নির্দেশে রাজেনবাবু, বিজন, শাশ্বতী, স্বাতী, হারীত, সত্যেন, প্রবীর-তিথিডাের-এর এইসব মানুষ, কখনাে হয়ে উঠেছে একাকিত্বের উপাসক, কখনাে নৈঃসঙ্গ্যপূজারী, কখনাে-বা তারা করেছে নির্বেদ-নিরানন্দের আরাধনা । বুদ্ধদেব বসুর তিথিডাের সংগঠনশৈলীতে এক মহাকাব্যিক উপন্যাস। ক্যানভাসের বিশালতা এউপন্যাসের অন্যতম সাংগঠনিক বৈশিষ্ট্য। বাংলা উপন্যাসের ধারায় তিথিডাের নিঃসন্দেহে সংযােজন করেছে এক নতুন মাত্রা। একটি বিশেষ কালকে ধারণ করে তিথিডাের হয়ে উঠেছে এক যুগন্ধর উপন্যাস, একই সঙ্গে যুগােত্তীর্ণও বটে। বুদ্ধদেব বসুর পত্নী শ্রীমতী প্রতিভা বসুর সম্মতি নিয়ে তিথিডাের প্রকাশিত হল।
Buddhadeb Bosu- তিনি নভেম্বর ৩০, ১৯০৮ কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। একজন খ্যাতনামা বাঙালি সাহিত্যিক। তিনি একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, গল্পকার, অনুবাদক, সম্পাদক ও সাহিত্য-সমালোচক ছিলেন। ১৯২১ সালে ১৩ বছর বয়সে তিনি ঢাকায় আসেন এবং প্রায় দশ বৎসর ঢাকায় শিক্ষালাভ করেন। বুদ্ধদেব বসু ১৯২৩ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯২৫ সালে ঐ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রথম বিভাগে পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। ১৯২৭ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে ঢাকা কলেজ) থেকে প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে আই. এ. পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে থেকে ইংরেজিতে ১৯৩০-এ প্রথম শ্রেণীতে বি. এ. অনার্স এবং ১৯৩১-এ প্রথম শ্রেণীতে এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ছিলেন মেধাবী এক ছাত্র। বি. এ. অনার্স পরীক্ষায় তিনি যে নম্বর লাভ করেন তা একটি রেকর্ড; এবং অদ্যাবধি (২০০৯) এ রেকর্ড অক্ষুণ্ণ আছে। তাঁর পিতা ভূদেব বসু পেশায় ঢাকা বারের উকিল ছিলেন। তাঁর মাতার নাম বিনয়কুমারী। বুদ্ধদেব বসুর মাতামহ চিন্তাহরণ সিংহ ছিলেন পুলিশ অফিসার। তাঁর পৈতৃক আদি নিবাস ছিল বিক্রমপুরের মালখানগর গ্রামে। জন্মের চব্বিশ ঘণ্টা পরেই তাঁর মাতা বিনয়কুমারীর ১৬ বছর বয়সে ধনুষ্টঙ্কার রোগে মৃত্যু ঘটে। এতে শোকাভিভূত হয়ে তাঁর পিতা সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করে গৃহত্যাগ করেন। মাতামহ চিন্তাহরণ ও মাতামহী স্বর্ণলতা সিংহ'র কাছে প্রতিপালিত হন বুদ্ধদেব। বুদ্ধদেবের শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের প্রথমভাগ কেটেছে কুমিল্লা, নোয়াখালী আর ঢাকায়। অল্প বয়স থেকেই কবিতা রচনা করেছেন, ছেলে জুটিয়ে নাটকের দল তৈরি করেছেন। প্রগতি ও কল্লোল নামে দু'টি পত্রিকায় লেখার অভিজ্ঞতা সম্বল করে যে কয়েকজন তরুণ বাঙালি লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরজীবদ্দশাতেই রবীন্দ্রনাথের প্রভাবের বাইরে সরে দাঁড়াবার দুঃসাহস করেছিলেন তিনি তাঁদের অন্যতম। ইংরেজি ভাষায় কবিতা, গল্প, প্রবন্ধাদি রচনা করে তিনি ইংল্যান্ড ও আমেরিকায়ও প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। তিনি মার্চ ১৮, ১৯৭৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন।