"একজন আলি কেনানের উত্থান পতন"বইটির প্রথমের কিছু অংশ: দে তর বাপরে একটা ট্যাহা। ভিখিরিরা সাধারণত ভিক্ষাদাতাকেই বাবা বলে ডাকে। আলি কেনান দাবি ছেড়ে বসল সম্পূর্ণ উল্টো। অর্থাৎ সে ভিক্ষাদাতার বাবা এবং একটা টাকা তাকে এখুনি দিয়ে দিতে হবে। একেবারে যাকে বলে কড়া নির্দেশ। এই চাওয়ার মধ্যে রীতিমত একটা চমক আছে। | লােকটা সদরঘাটের লঞ্চ থেকে এই বুঝি নেমেছে। পরনে ময়লা পাজামা-পাঞ্জাবি। দোহারা চেহারার ফুলাে ফুলাে মুখের মানুষটি। আলি কেনানের মুখ থেকে সদ্য নির্গত বন্দুকের গুলির মত শব্দ ক’টি শুনে কেমন জানি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। গােল গােল সরল চোখ দুটি পাকিয়ে তাকায়। আলি কেনান ইত্যবসরে ভঁটার মত জ্বলজ্বলে চোখ দুটো লােকটার চোখের ওপর স্থাপন করে আরাে জোরের সাথে উচ্চারণ করে, কইলাম না তর বাপরে একটা ট্যাহা দিয়া দে। ন্ট লােকটা বােধহয় সারারাত লঞ্চে ঘুমােতে পারেনি। চোখে-মুখে একটা অসহায় অসহায় ভাব। অথবা এমনও হতে পারে কোর্টে তার মামলা আছে। যা-হােক লােকটি দ্বিরুক্তি না করে ডান হাতের প্রায় ছিড়ে যাওয়া ব্যাগটা বাঁহাতে চালান করে পকেট থেকে একখানা এক টাকার মলিন বিবর্ণ নােট বের করে আলি কেনানের হাতে দিয়ে ফুটপাথ ধরে হেঁটে চলে যায়। আলি কেনানের জীবনের এই প্রথম ভিক্ষাবৃত্তি। তাতে আশানুরূপ সফল হওয়ায় শরীরে মনে একটা তড়িৎ-প্রবাহ খেলে গেল। শুধুমাত্র একটা ধমকের জোরে পরের পকেট থেকে টাকা বের করে আনা যায়, আলি কেনানের জীবনে এটা একটা অভিনব ঘটনা। সেদিন থেকেই তার জীবনে নতুন একটা অধ্যায়ের সূত্রপাত হল। | আলি কেনান গত দুদিন ধরে কিছু খায়নি। শহরের কলের পানি ছাড়া ভাগ্যে তার অন্যকোন বস্তু জুটেনি। গত তিন মাস থেকে চম্পানগর লেনের একটি হােটেলে সে সকালের নাস্তা এবং দুবেলার খাবার খেয়ে আসছিল। প্রথম দু মাস সে নগদ পয়সা দিয়ে খেয়েছে। সেই সুবাদে হােটেল
বাঙালি মুসলিম লেখকদের মধ্যে অন্যতম কীর্তিমান কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফা একাধারে ছিলেন কবি, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক, গণবুদ্ধিজীবী ও চিন্তাবিদ। বাবা-মায়ের দ্বিতীয় সন্তান আহমদ ছফা জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৩ সালের ৩০ জুন, চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া গ্রামে। নিজ এলাকায় তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়, এবং ১৯৫৭ সালে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত হন এবং মাস্টারদা সূর্যসেনের আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হলেও সেখানে পড়ালেখা শেষ করেননি, এবং জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের অধীনে পিএইচডি শুরু করলেও তা আর শেষ করা হয়ে ওঠেনি। আহমদ ছফা এর বই সমূহ বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পাঠকদের মধ্যে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বই হিসেবে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা প্রবন্ধগ্রন্থ ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’। আহমদ ছফা এর বই সমূহের মাঝে 'ওঙ্কার', 'অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী', 'বাঙালি মুসলমানের মন', যদ্যপি আমার গুরু', 'গাভী বিত্তান্ত' প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য কীর্তি হলো জার্মান সাহিত্যিক গ্যাটের অমর সাহিত্যকর্ম 'ফাউস্ট' বাংলায় অনুবাদ করা। আহমদ ছফা এর বই সমগ্র একত্রিত করে রচনাবলি আকারে ৯টি খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানবিরোধী এই সাহিত্যিক 'লেখক শিবির পুরস্কার' ও বাংলা একাডেমির ‘সাদত আলী আখন্দ পুরস্কার’ পেলেও সেগুলো গ্রহণ করেননি। এই পাঠকনন্দিত সাহিত্যিক ২০০১ সালের ২৮ জুলাই ৫৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক মরণোত্তর 'একুশে পদকে' ভূষিত হন।