"আরববিশ্বে ইসলামি শাসনের পতন ও তার নেপথ্যকথা" বইয়ের সংক্ষিপ্ত কথা: আরববিশ্ব আজ যেন জ্বলন্ত চুলার ওপর উত্তপ্ত এক কড়াই। সর্বত্র বিস্ফোরিত এক ভয়ানক আগ্নেয়গিরির মতো। কোথাও যদি তা থেমে যায়, তবে মনে হবে তার পূর্বে গত হয়েছে এক কঠিন বজ্রাঘাত। সম্প্রতি মুসলিমদের ওপর অন্যায়-অবিচার ও দমন-নিপীড়ন সুস্পষ্ট ও সুপ্রকাশিত। তারা আজ ষড়যন্ত্রকারীদের ভয়ানক চক্রান্তের শিকার। মুসলিমদের বিরুদ্ধে পাতা একাধিক প্রতারণার ফাঁদের বিষয়টি এখন সর্বজনসিদ্ধ। ব্যক্তি থেকে সমাজ, পরিবার থেকে রাষ্ট্র; সবখানেই এ ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতা এখন আরও প্রবল। যুগে যুগেও এমনটি লক্ষ করা গেছে।
১৮৮৩ সালে প্রণীত মিসরের সংবিধানটি ছিল মূলত ফ্রান্সের তৈরি। ফরাসি থেকে আরবিতে ভাষান্তর করে আরবি কপিকেই মূলকপি বলে প্রচার করা হয়েছে। আর ফরাসি কপিকে অনূদিত প্রতিলিপি বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ সবই ছিল মিথ্যা, বানোয়াট এবং আমাদের বিবেক-বুদ্ধি নিয়ে হাসি-ঠাট্টার সামান্য উদাহরণমাত্র। ইরাকেও ঘটেছিল এমনটি। ১৯১৮ সালে প্রণীত সেখানকার ফৌজদারি আইনটি মূলত ছিল ইংরেজিতে। পরবর্তী সময়ে আরবিতে অনুবাদ করে সেটিকেই মূলকপি হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে। ১৯৫৬ সনে লিবিয়া স্বাধীন হওয়ার পর সেখানেও এরূপ ঘটেছিল। এসবের পেছনে উদ্দেশ্য ছিল কোনোকিছু বুঝে ওঠার আগেই মুসলিমবিশ্বে ইসলামি শাসনব্যবস্থাকে (শরিয়ত) কৌশলে নির্মূল করে দেওয়া।
তুর্কি সংবিধান নির্মূল করার পর তুরস্কে এক আজব ও অদ্ভুত নাগরিক-বিধি প্রণয়ন করা হয়েছিল। তুর্কি বিচারকবৃন্দ আঙ্কারার প্রবর্তিত সেই সুইস সংবিধানগুলো বুঝতে দীর্ঘদিন পর্যন্ত অপারগ ছিল। তা ছাড়া ইতালি থেকে সংগৃহীত অপরাধ দণ্ডবিধিকে বুঝতেও তুরস্কের বহু বছর লেগে গিয়েছিল। শেষপর্যন্ত ইতালিস্থ খ্রিষ্টান ধর্মযাজকদের দ্বারা সংশোধনী এনে সেগুলো সম্পাদন করা হয়েছিল। বিষয়টির ব্যাপকতা এবং তাৎপর্যের দিকে লক্ষ করে আরববিশ্বের শক্তিমান লেখক ড. ওমর সুলাইমান আল-আশকার গভীর গবেষণায় মনোযোগী হয়েছিলেন। তার গবেষণার চূড়ান্ত ফলাফলই হচ্ছে ‘আরববিশ্বে ইসলামি শাসনের পতন ও তার নেপথ্যকথা’।
গ্রন্থটির মূল আলোচনা ছয়টি অধ্যায়ে ভাগ করা : প্রথম অধ্যায়ে প্রাচীন ও সাম্প্রতিক কালের তৈরি প্রসিদ্ধ সংবিধানসমূহের আলোচনা। এসব সংবিধানের অন্যায় ও অপরিপক্বতার বিষয়টি স্পষ্ট। দ্বিতীয় অধ্যায়ে মুসলিমবিশ্বে তথাকথিত সংবিধান রচনার ইতিহাস ও রাজনীতির নামে ইসলামি শাসনব্যবস্থা অপসারণের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা। এরপর মিসর, তুরস্ক, লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, জর্ডান, ভারত ও পাকিস্তানে পর্যায়ক্রমে এসব সংবিধানের অনুপ্রবেশ ও তাতে ইসলামি শাসনব্যবস্থা নির্মূলের বৃত্তান্ত বর্ণনা। পরিশেষে ইসলামি বিশ্বে ফৌজদারি আইনের ইতিবৃত্ত আলোচনা করে ব্যভিচার এবং এ-জাতীয় অপরাধদণ্ড সংস্কার-সম্পর্কিত বিশদ আলোচনা রয়েছে। তা ছাড়া ইসলামি ফৌজদারি আইনের সাথে এর বিস্তর পার্থক্যের বিষয়টিও স্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে। তৃতীয় অধ্যায়ে পর্যায়ক্রমে ইসলামি শাসনব্যবস্থা নির্মূলে ক্রুসেডারদের নিরবচ্ছিন্ন অপপ্রয়াসের আগাগোড়া আলোচনা। আশা করি, শত্রুদের এসব ষড়যন্ত্র ও দুরভিসন্ধির ইতিহাস জেনে আপনিও সতর্ক হবেন। অনেক গোপন বিষয়ে অবহিত হয়ে সে জন্য যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণে মনোনিবেশ করবেন। চতুর্থ অধ্যায়ে মিসরে প্রণীত ও প্রয়োগকৃত নাগরিক বিধির বিস্তারিত আলোচনা। পাঠক ভালো করেই বুঝতে পারবেন, কীভাবে শত্রুরা আমাদের ওপর অসত্যের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দোসরদের তারা কীভাবে ব্যবহার করেছে। কীভাবে ন্যায় চাপা দিয়ে মুসলিমবিশ্বকে প্রতারিত করেছে। এ জন্য মিসরকে বেছে নেওয়ার কারণ— মিসর হলো আরববিশ্বের জ্ঞান ও ঐতিহ্যের প্রাণকেন্দ্র। দেখবেন, মিসরে প্রতিফলিত সবগুলো বিধান ও সকল ব্যবস্থাই ধীরে ধীরে অন্যসব আরব রাষ্ট্রেও প্রবাহিত হয়েছে। পঞ্চম অধ্যায়ে মুসলিমদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এ চক্রান্ত হতে তাদের বের হয়ে আসার জোর আহ্বান জানানো হয়েছে লেখকের পক্ষ থেকে। লেখক বোঝাতে চেয়েছেন, এ সকল সংবিধান আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। এগুলোর মাধ্যমে কেবল কাফেরদের সেবা ও তাদের জন্য মুসলিমবিশ্বের সম্পদ বৈধ করা ছাড়া ভিন্ন কিছু সাধিত হয় না; উপরন্তু তা আল্লাহর প্রণীত বিধানের স্পষ্ট বিরোধিতা। বরং মুসলিমবিশ্বের উচিত, উম্মতের সংশোধন ত্বরান্বিত করতে অবিলম্বে ইসলামি শাসন বাস্তবায়ন করা। মুসলিম দেশগুলোর পারস্পরিক ঐক্য ও সম্প্রীতি সাধনের জন্য এটিই প্রধান শর্ত। পরিশেষে অনৈসলামি আইনে বিচার প্রয়োগকারীদের পরিণতি ও তাদের বিধান সম্পর্কে রয়েছে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা। সংশয় দূর করতে স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে— এ ধরনের আইন জারি করে মানুষ কখন ইসলামের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে যায়। সর্বশেষ অধ্যায়টি পূর্বের সকল অধ্যায়ের উপসংহার। সেখানে পূর্ববর্তী ও পরবর্তীকালের বিদগ্ধ আলেমদের দেওয়া ফতোয়া ও বাণী একত্র করে উপস্থাপন করা হয়েছে। বিভিন্ন প্রসিদ্ধ গ্রন্থ থেকে খুঁজে খুঁজে বের করে সেগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। আশা করি, বাতিলপন্থীদের বিরামহীন প্রচারণায় প্রতারিত সরলমনা মুসলমানগণ বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারবেন।
ড. ওমর সুলাইমান আল-আশকার। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে ফিলিস্তিনের নাবলুস প্রদেশের ‘বারকা’ গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নেয়া এ মনীষী ছিলেন বিখ্যাত ফিকহ মূলনীতিবিদ মুহাম্মদ সুলাইমা আল-আশকারের সহোদর। শিক্ষাজীবনের শুরুলগ্নে ফিলিস্তিন থেকে তিনি সৌদি আরবে চলে যান। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করেন কিং সাওদ ইউনিভার্সিটি থেকে। এরপর সেখানকার ‘কুল্লিয়া শরিয়া’ থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও শরিয়া বিষয়ে ডক্টরেট অর্জন করেন। তিনি একাধারে জর্ডান ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, কুয়েত ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় এবং আল-যারকা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ছিলেন। ছিলেন জর্ডানের রাষ্ট্রীয় ইফতাবোর্ডের সম্মানিত সদস্য। ইসলামি আকিদা ও সমকালীন বিশ্বপ্রেক্ষাপট নিয়ে তাঁর গবেষণাপূর্ণ রচনাবলি আরববিশ্বে ব্যাপক ও বহুল প্রচার লাভ করেছে। ইসলামি আকিদা, সমকালীন প্রেক্ষাপট, মুসলমানদের অবস্থা এবং যুগচাহিদার প্রেক্ষিতে তাদের করণীয়-বর্জনীয় বিষয়ক বহু গ্রন্থ রচনা করেন এ বিদগ্ধ মনীষী। ১০ আগস্ট ২০১২ ইং মোতাবেক ২২ রমযান ১৪৩৩ হিজরিতে অসুস্থ অবস্থায় ৭২ বছর বয়সে জর্ডানের রাজধানী আম্মানে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।