| লোকপ্রিয়তা সত্ত্বেও আবুল বাশার ক্রমান্বয়ে নতুন বিষয়বস্তুর অন্বেষণে ও ভাষা-আঙ্গিক উদ্ভাবনে ব্যাপৃত। সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এই লেখক একই সঙ্গে লৌকিক এবং অলৌকিক; লোকায়ত সহজিয়া এবং নাগরিক বৈদগ্ধ্যে কখনও অসহজ। খুব চেনা মনে হলেও গভীরভাবে অপরিজ্ঞাত জীবনকে পাঠকের সামনে মেলে ধরা তাঁর সাহিত্যিক কৌশল—এমনকী শিক্ষিত নাগরিক মধ্যবিত্তের নাগাল ছাড়িয়ে গ্রাম-ভারতের যে-বিচিত্র জনপদ অবজ্ঞায়-অবহেলায় পড়ে আছে, সেই বিস্তীর্ণ লোকের পরম-আখ্যান প্রস্তুত করেন এই লেখক। মহানগর এবং মহাগ্রাম;
কীট-পতঙ্গ-পাখি-গোরু-গোর; মাছ-বায়ু-নদী: শস্য-মাঠ-মোষ চরভূমি তাঁর করায়ত্ত পৃথিবী; এই কথাকার নদীকেই উৎসর্গ করেন বই; কিংবা যা তাঁর অন্তরগত তাকেই। মাটির উপরের কাহিনীর সঙ্গে মাটির ভিতরের গল্প বলা তাঁর বৈশিষ্ট্য। পুরাণ-কথা এবং লোককথায় পারদর্শী এমন জীবনাভিজ্ঞ কথক কমই আছেন। বাশারের সাহিত্যে একটি গাভী যেমন ভগবতী, তেমনই এই প্রাণী কোরান-গুঞ্জিত আয়াত। রাজনীতির সক্রিয় কৃষক অভিজ্ঞতা তাঁকে দিয়েছে ব্রাত্য-প্রান্তিকতার আবাদ—একজন মুচি ও একজন বাঙালি লেখক সমান্তর হয়ে ওঠে তাঁর লেখায়। সেই সুবাদে শূদ্র অধ্যাপক এবং অজপ্রাণী হয়ে ওঠে সমপ্রাণ সমনায়ক। ছ'জন মদনকে নিয়ে গড়ে ওঠে মদনভস্মের আখ্যান। অর্ধ-স্বপ্নাচ্ছন্ন ইতিহাস থেকে গড়ে ওঠে টাঙ্গাচালক হতদরিদ্র মোতা নবাবের মুর্শিদাবাদী কাহিনী, তা এক শ্রেণীচ্যুতা বাইজির স্বপ্ন-প্রয়াণ। আবার জড়পিণ্ড এক যৌবনোদ্ভিন্নাকে ঘিরে প্রণয়-চেতনার গল্প — চেতন-অচেতনের এমন দ্বন্দ্বও অপূর্ব। পূর্ব-কথিত রাজনীতি শিকার করে নিষিদ্ধ উপজীবিকায় বাধ্য নারীকে, চর-চরানি মেয়ের গর্ভে জন্ম নেয় সেই জীবন-শিকারের গল্প। এ ছাড়াও এই উপন্যাস-সংগ্রহে গৃহীত হয়েছে মনস্তত্ত্ব প্রধান আত্মানুসন্ধানী নিঃসঙ্গ প্রেম, ডার্ক কমেডি-কাহিনী। সেই সঙ্গে কসমেটিক সার্জারি ও ভোগবাদের দ্বন্দ্ব; ধর্ষ ও রূপান্তরকামের দ্বৈরথ—কাব্যানুভূত প্রণয়-পিপাসার অক্ষ ট্র্যাজেডি। এবং রয়েছে হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্বের মিলন-উৎস সন্ধানী কাহিনীও। ভোরের প্রসূতি, সঈদা বাঈ, সুরের সাম্পান, ময়ূরী এবং ময়ূরী, স্পর্শের বাইরে, জল মাটি আগুনের উপাখ্যান, ভেতরে আসতে দাও, শেষ রূপকথা, পবিত্র অসুখ ও নরম হৃদয়ের চিহ্ন বাছাই করা এই দশটি উপন্যাস নিয়ে এই সমগ্র। আবুল বাশার-এর জীবনযাপনের পর্যবেক্ষণের স্বাতন্ত্র্যের স্বাক্ষর।
তাঁর জন্ম ১৯৫১ খ্রীস্টাব্দ। ছ-বছর বয়সে সপরিবার গ্রাম তাগ। মুর্শিদাবাদের লালবাগ মহকুমার টেকা গ্রামে বসবাস শুরু। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্যের স্নাতক। হিন্দিভাষা-সাহিত্যেরও ডিপ্লোমা। গ্রামের স্কুলে ১০-১২ বছর চাকুরি। বর্তমান কর্মস্থল সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকা। দারিদ্র্যের চাপ আর সামাজিক বিষমতা ও পীড়ন কৈশোরেই লেখালেখিতে প্ররোচিত। উত্তীর্ণকৈশোরে, ১৯৭১ সালে, প্রথমে কবিতাগ্রন্থের প্রকাশ। নাম : ‘জড় উপড়ানো ডালাপা ভাঙা আর এক ঋতু’। পরবর্তী এক দশক লেখালেখি বন্ধ। জড়িয়ে পড়েন সক্রিয় রাজনীতিতে। বহরমপুরের ‘রৌরব’ পত্রিকাগোষ্ঠীর প্রেরণায় লেখালেখিতে প্রত্যাবর্তন। কবিতা ছেড়ে এবার গল্পে। প্রথম মুদ্রিত গল্প-‘মাটি ছেড়ে যায়’। তাঁর ‘ফুলবউ’ উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন ১৩৯৪ সালের আনন্দ-পুরস্কার।