ভূমিকা ১. মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনী’- গ্রন্থের লেখক বীর মুক্তিযােদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরী আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের এক অনুধীত অধ্যায়ের উন্মােচন করেছেন। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের অনেক তথ্যই এখনােও উন্মােচিত হয়নি। আমাদের জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব অপরিসীম। প্রতিটি নাগরিককেই তা জানা দরকার। ১.২. লেখক আমাদের মুক্তিযুদ্ধের রীতিমতাে গবেষণাধর্মী ইতিহাস তুলে ধরেছেন। তিনি মুক্তিবাহিনীর সক্রিয় সদস্য হিসেবে যে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম করেছেন এবং তাঁর লব্ধ অভিজ্ঞতা থেকে অত্যন্ত প্রাঞ্জল বিবরণ তুলে ধরেছেন। যা পরবর্তীকালে অনিসন্ধিৎসু ও জ্ঞানপিপাসু লেখকদের গবেষণায় কাজে লাগবে। ১.৩. একদিকে তিনি যেমন বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে মুক্তিযুদ্ধের বিবরণ দিয়েছেন তেমনি কেন মুজিব বাহিনী গঠন করা হয়েছিল- তার যৌক্তিক ব্যাখ্যা দানে সচেস্ট হয়েছেন। তিনি প্রচুর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে সজীব করে তুলেছেন এই বিরল গ্রন্থের পাতা। ২. ১৯৬৯ সালে লন্ডনে হামস্টেড হিথের একটি বাড়িতে মিসেস ইন্ধিরা গান্ধীর সাথে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতির বস্তুনিষ্ঠ প্রমাণ এতে রয়েছে। কারণ পাকিস্তানীরা যে, ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না বঙ্গবন্ধু তা বুঝতে পেরেছিলেন। সে জন্যই তিনি তাঁর অনুসারী ছেলেদের সামরিক প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধপ্রস্তুতির পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। এখানেই রয়েছে মুজিব বাহিনী গঠনের মূলসূত্র। ২.১. শেখ মনি, তােফায়েল আহমদ, আব্দুর রাজ্জাক, সিরাজুল আলম খানেরমত ছাত্র নেতৃবৃন্দ নিয়ে মুজিব বাহিনী কিভাবে গড়ে তােলা হয়েছিল লেখক তাঁর সুস্পষ্ট বিবরণ দিয়েছেন। ২.২. ভারতীয় জেনারেল মি. ওভান এই বাহিনীর প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন। দেরাদুনের কাছে চাকতারা নামক স্থানে ছিল মুজিব বাহিনীর বিশেষ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। তাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রশস্ত্র ছিল অপেক্ষাকৃত উন্নততর। এমনকি জেনারেল ওসমানী সাহেবও এই বাহিনী সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানতেন না। মুজিবনগর সরকারের মুখপাত্র বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদও এই বিষয়ে তেমন কিছু জানতেন না। লেখক বলেছেন, “ মুজিব বাহিনীর যােদ্ধাদের নিয়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গ্রামে গ্রামে চলমান মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা ইউনিট গড়ে উঠে। দীর্ঘমেয়াদি জনযুদ্ধের মাধ্যমে শুধু দেশকে মুক্ত করাই নয় দেশের মানুষের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যই ছিল মুজিব বাহিনীর যুদ্ধকালীন রণকৌশল”। ৩. মুজিব বাহিনীর ইতিহাস বিবৃত করতে গিয়ে তিনি দেশের প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং বহু মুক্তিযােদ্ধার ভূমিকা উল্লেখ করেছেন-যা সবার জানা দরকার। ৩.১. প্রশিক্ষণ শেষে বাংলাদেশের ভিতরে প্রত্যক্ষ যুদ্ধক্ষেত্রে মুজিব বাহিনীর ভূমিকা এবং যুদ্ধের এক নিপুণ বিবরণ এই গ্রন্থে পাওয়া যাবে। ৩.২. মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মুজিবনগর সরকার ও ভারতীয় বন্ধদের বৈদেশিক কটনীতি এবং সহায়ক কর্মকাণ্ডেরও কিছুটা বিবরণ পাওয়া যাবে এই গ্রন্থে। ৩.৩. যুদ্ধ শেষে স্বদেশে বঙ্গবন্ধুর বীরত্বপূর্ণ প্রত্যাবর্তন, পরবর্তীকালে ছাত্রলীগের বিভক্তি এবং জাসদের উত্থানের এক বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ তিনি উপস্থাপন করেছেন। এমনকি রক্ষীবাহিনী গঠন এবং কিছু কিছু মুক্তিযােদ্ধার হতাশা, রাজনীতির জটিলতা, দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতি, দুর্নীতি, জনমনে হতাশা ও রাজনীতির অস্থিরতার বিবরণ রয়েছে এই গ্রন্থে। ৩.৪. ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ড এবং পরবর্তীতে সামরিক কু পাল্টা কু এসবের বিবরণ দিয়েছেন তিনি। এমন একটি সুখপাঠ্য গ্রন্থের খুব প্রয়ােজন রয়েছে আমাদের জাতীয় জীবনে। ৩.৫. সুসাহিত্যিক মরহুম খালেকদাদ চৌধুরী সাহেবের সুযােগ্য পুত্র অত্র গ্রন্থের লেখক বীর মুক্তিযােদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরী একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন বলে আমি মনে করি। এই পুস্তক নিঃসন্দেহে কালের সাক্ষী হয়ে থাকবে।