এক কুফরি ফেতনা ইংরেজরা আজাদির এসকল সেনানী এবং উলামায়ে হক-কে সবচেয়ে বড় দুশমন মনে করত। যখন তারা দারুল উলুম দেওবন্দ এবং আকাবের দারুল উলুমের ইলমি ও দীনি প্রভাব বিস্তার হতে দেখল, তখন তারা ইসলামের এই ঝর্ণাধারাকে বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করল। তারা দুনিয়া পুজারী কিছু মৌলভি ও পির ক্রয় করল। তাদের দিয়ে আকাবিরে দেওবন্দের ওপর ওহাবিয়াতের অপবাদ লাগাল। তারও আগে আকাবিরে দেওবন্দের পূর্বসূরী ইমামুল মুজাহিদিন, কামেল ব্যাক্তিত্যের নেতা, সায়্যেদ আহমদ শহিদ বেরেলভি রহ. এবং আলেমে রব্বানি, বীর মুজাহিদ মাওলানা শাহ ইসমাঈল শহিদ রহ.-এর জিহাদি তৎপরতাগুলোকেও ওহাবিয়াতের অপবাদ দিয়ে ব্যর্থ করার চেষ্টা করেছিল। আল্লাহ মালুম, কোন কারণে ফেরকায়ে বেরেলভির প্রবক্তা মৌলভি আহমদ রেজা খান বেরেলভি আকাবিরে দেওবন্দের বিরুদ্ধে কুফুরি প্রচেষ্টা জোরদার করেছিল। ‘হুসামুল হারামাইন’-এর বাস্তবতা মৌলভি আহমদ রেজাখান বেরেলভি ১৩২৩ হিজরিতে হজের সফরে যায়। হজ শেষ করে সে মক্কাতে বসেই একটি পুস্তক রচনা করে। যাতে সে আকাবিরে দেওবন্দের লিখিত বাক্যের শব্দ এবং অর্থ পরিবর্তন করে উপস্থাপন করে। আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনুগত্য এবং মহব্বতে ডুবে থাকা ব্যক্তিদের নামে এই অপবাদ লাগাল যে, ‘তারা তাদের কিতাবে আল্লাহকে অস্বীকার করেছে এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালি দিয়েছে।’ (নাউযুবিল্লাহ) পুস্তিকাটি এভাবে লিখে যে, প্রথমে কাদিয়ানি মতবাদের শিরোনামে মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানির কুফুরি বাক্যগুলো তুলে ধরে এবং তারপর আকাবিরে দেওবন্দকে ফেরকায়ে ওহাবিয়া কাযযাবিয়া এবং ফেরকায়ে ওহাবিয়া শয়তানিয়া ইত্যাদি বিভিন্ন শিরোনামে বিভিন্ন ফেরাকায় ভাগ করে। যাতে সাধারণ মানুষ এ কথা মনে করে যে, কাদিয়ানিদের মতো হিন্দুস্থানেও একটি নতুন ফেরকাহ তৈরি হয়েছে। এই পুস্তিকায় আকাবিরে দেওবন্দের মধ্য থেকে হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা কাসেম নানুতভি রহ., কুতুবুল ইরশাদ, আবু দাউদের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘বাযলুল মাজহুদ’-এর লেখক মাওলানা খলিল আহমদ সাহারানপুরি রহ. এবং হাজি এমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কি রহ. এর খলিফা হাকিমুল উম্মাত মাওলানা আশরাফ আলি থানভি রহ.-এর বাক্যসমূহ ভেঙ্গে ভেঙ্গে উপস্থাপন করে। তারপর তাদের নামে অকাট্য কাফের হওয়ার ফাতওয়া জারি করে। এমনকি এ কথাও লেখে যে, যারা তাদেরকে কাফের না বলবে তারাও কাফের। মক্কা মদিনার আলেমগণ থেকে এই ফাতওয়ার সত্যায়নের জন্য বিভিন্ন মাধ্যম অবলম্বন করে তার উদ্দেশ্য হাসিল করে। মক্কা-মদিনার আলেমগণ যেহেতু আকাবিরে দেওবন্দের লিখিত কিতাবাদি সম্পর্কে ধারণা রাখতেন না, তাই তারা তার লেখা পুস্তকের তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই ফাতওয়ার সত্যায়ন করে দেন। মন্তব্যের ক্ষেত্রে তাদের অধিকাংশ আলেম লেখেন, তাদের আকিদা যদি অনুরুপ-ই হয়, তাহলে ফাতওয়া ঠিক আছে। হজের সফর থেকে ফেরার পর সে কিছুদিন চুপ করে থাকে। তারপর মৌলভি আহমদ রেজা খান বেরেলভি ১৩২৫ হিজরিতে পুস্তকটি ‘হুসামুল হারামাইন’ নামে প্রকাশ করে। আল মুহান্নাদ আলাল মুফান্নাদ ওই দিনগুলোতে শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানি রহ. মদিনা মুনাওয়ারাতেই উপস্থিত ছিলেন এবং মসজিদে নববিতে তার পাঠ দানে খুব ব্যাস্ত ছিলেন। আর ‘হুসামুল হারামাইন’-এর ব্যাপারটা এতো গোপনীয়তার সাথে করা হয়েছিল যে, এ ব্যাপারে তিনি কিছুই জানতেন না। এই কুফুরি চক্রান্ত সম্পর্কে জানার পর তিনি মক্কা-মদিনার আলেমগণকে এর বাস্তবতা সম্পর্কে জানান। এতে তারা ২৬টি প্রশ্ন লিখে আকাবিরে দেওবন্দের নিকট জওয়াব দেয়ার জন্য পাঠিয়ে দেন। ততোদিনে রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি রহ. এবং কাসেম নানুতভি রহ. ইন্তেকাল করেছিলেন। যারফলে প্রশ্নগুলোর জবাব শুদ্ধ এবং সাহিত্যিক আরবি ভাষায় ফখরুল মুহাদ্দেসিন মাওলানা খলিল আহমদ সাহারানপুরি রহ.ই লেখেন। আর তৎকালিন প্রসিদ্ধ সকল আকাবিরে দেওবন্দ যেমন, শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দি রহ., হাকিমুল উম্মাত মাওলানা আশরাফ আলি থানভি রহ., সালেহিনদের আদর্শ মাওলানা শাহ আব্দুর রহিম রায়পুরী রহ., কাসেম নানুতভি রহ.-এর সাহেবজাদা ও দারুল উলুম দেওবন্দের মুহতামিম মাওলানা হাফেজ আহমদ রহ., দারুল উলুম দেওবন্দের মুফতিয়ে আজম মাওলানা আজিজুর রহমান রহ. এবং মুফতিয়ে আযম মাওলানা কেফায়াতুল্লাহ দেহলভি রহ. সকলেই ওই জওয়াবের ওপর লিখিত সত্যায়ন করেন। হিন্দুস্তানের প্রসিদ্ধ উলামায়ে কেরাম ছাড়াও হিজাজ, মিশর এবং শাম‘সহ অন্যান্য ইসলামি রাষ্ট্র্রের নেতৃস্থানীয় উলামায়ে কেরাম নিজ নিজ লিখিত সত্যায়নের মাধ্যমে উক্ত জরয়াবের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেন। ১৩২৫ হিজরিতে ওই পুস্তিকা লেখা হয় এবং তা ‘আল মুহান্নাদ আলাল মুফান্নাদ’ নামে প্রকাশ করা হয়। চলমান এই পুস্তিকাটিতে উল্লেখিত পুস্তিকার প্রশ্নগুলোর ওপর ভিত্তি করে আকাবিরে দেওবন্দের সঠিক আকিদাগুলো ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। যার মাধ্যমে বিরোধী এবং শত্রুদের চোখের সামনে চক্রান্তের কুয়াশাচ্ছন্ন পর্দা দূরীভুত হয়ে আকাবিরে দেওবন্দের সত্য এবং সঠিক আকিদা স্পষ্ট হয়েছে। আর ‘আল মুহান্নাদ’ আকাবিরে দেওবন্দের জন্য একটি সর্বস্বীকৃত ঐতিহাসিক সনদ। এতে দেওবন্দি আকিদা মৌলিকভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে।