সাহিত্যের চতুরঙ্গ-বর্জ্যে তার সার্থক আত্মপ্রকাশের কথা বলা হয়েছে। কাব্যে বিশেষত প্রথমদিককার রঙ্গব্যঙ্গমিশ্র হাস্যরস কাব্যে তাঁর পরিহাসরসিক চিত্তের সমধিক পরিচয় পাওয়া যাবে। নাট্য-সাহিত্যে-বিশেষত জীবনী-নাট্য-রচনায় মধুসূদনবিদ্যাসাগরের স্রষ্টা হিসেবে তাঁকে নবযুগের পথিকৃৎ বলা যেতে পারে। কিন্তু কথাসাহিত্যেই তার শক্তিমত্তার সম্পূর্ণ বিকাশ সম্ভব হয়েছে। অবশ্য সেক্ষেত্রেও ঔপন্যাসিক বনফুল আর ছােটগল্প-স্রষ্টা বনফুলের মধ্যে পার্থক্য অনেক। উপন্যাস তার নিত্যনবায়মান শক্তিমত্তার সাক্ষ্যমঞ্চ, কিন্তু ছােটগল্পেই রয়েছে তার ব্যক্তিত্ব, তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর। উপন্যাসে কত বিচিত্র মানুষ; কত বিচিত্র কাহিনী; কত বিচিত্র ধরনে তাদের কথা বলার সজ্ঞান সচেতন প্রয়াস। জীবনকে শিল্পে ধরে রাখার কত নতুন নতুন প্রয়ােগ নৈপুণ্য! সাহিত্য-শিল্পীর সেখানে কৃতিত্ব অপরিসীম। কিন্তু সৃষ্টিপ্রেরণা ও সৃষ্টিধর্ম যেখানে অপৃথগ্যত্বসত সেখানেই বাণীপ্রকাশ চরমােৎকর্ষ লাভ করে। সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে স্রষ্টাও সেখানে স্বয়ংপ্রকাশ। ছােটগল্পের ক্ষেত্রেই বনফুলের এই আত্মপ্রকাশ সবচেয়ে সার্থক ও সহজ হয়ে উঠেছে। এখানেই তার জীবনদর্শন সম্যক স্ফূর্তি পেয়েছে। তাঁর শিল্পরীতি তাঁর ব্যক্তিত্বেরই প্রতীক হতে পেরেছে।
আসল নাম বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় । জন্ম: ১৯ জুলাই, ১৮৯৯ সালে। তিনি একজন বাঙালি কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ও কবি। তিনি বনফুল ছদ্মনামেই অধিক পরিচিত। অবিভক্ত ভারতবর্ষের বিহার রাজ্যেরমনিহারীতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের পিতার নাম ডা. সত্যনারায়ণ মুখোপাধ্যায় ও মাতা মৃণালিনী দেবী। তাদের আদি নিবাস হুগলী জেলার শিয়াখালা। কিন্তু তিনি বিহারের পূর্ণিয়া জেলার মণিহারী গ্রামে জন্মগ্রহণ । প্রথমে মণিহারী স্কুলে এবং পরে সাহেবগঞ্জ জেলার সাহেবগঞ্জ উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়ে তিনি লেখাপড়া করেন। শেষোক্ত স্কুল থেকে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে প্রবেশিকা (এন্ট্রান্স) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে তিনি আই.এস.সি, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন হাজারীবাগ সেন্ট কলম্বাস কলেজ থেকে। কলকাতা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন তবে পাটনা মেডিক্যাল কলেজে থেকে এম.বি, ডিগ্রী লাভ করেন। প্যাথলজিস্ট হিসাবে ৪০ বৎসর কাজ করেছেন। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে স্থায়ীভাবে কলকাতায় বসবাস করতে শুরু করেন। শিক্ষকদের কাছ থেকে নিজের নাম লুকোতে তিনি বনফুল ছদ্মনামের আশ্রয় নেন। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে সাহেবগঞ্জ স্কুলে পড়ার সময় মালঞ্চ পত্রিকায় একটি কবিতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে তাঁর সাহিত্যিক জীবনের সূত্রপাত ঘটে। নিয়মিত প্রবাসী, ভারতী এবং সমসাময়িক অন্যান্য পত্রিকায় ছোটগল্প প্রকাশ করেন। লেখক হিসেবে বনফুল হাজারেরও বেশি কবিতা, ৫৮৬টি ছোট গল্প, ৬০টি উপন্যাস, ৫টি নাটক, জীবনী ছাড়াও অসংখ্য প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তাঁর রচনাবলীসমগ্র ২২ খণ্ডে প্রকাশিত। তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি 'পদ্মভূষণ' উপাধি লাভ করেন। এছাড়াও তিনি শরৎস্মৃতি পুরস্কার (১৯৫১), রবীন্দ্র পুরস্কার (১৯৬২), বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের জগত্তারিণী পদক (১৯৬৭)। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডিলিট উপাধি প্রদান করে ১৯৭৩ সালে। ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দের ৯ ফেব্রুয়ারি তারিখে কলকাতা শহরে তাঁর মৃত্যু হয়।