"শ্রদ্ধাঞ্জলি" বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা: খবরটা গর্বের, কিন্তু আনন্দের নয় । এমন-কিছু বীর কিশাের-কিশােরীর কথা আমরাও পড়েছি খবরের কাগজে, শুনেছি বেতারে কি দূরদর্শনে, অন্যের প্রাণ বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে যারা, উৎসর্গ করেছে প্রাণ, আর সেই দুর্লভ সাহসিকতা ও পরার্থপরতাকে সম্মান জানাতে যাদের নামে ঘােষিত হয়েছে মরণােত্তর জাতীয় পুরস্কার, দিল্লির এক বিশেষ অনুষ্ঠানে এই শহিদদের নিকটতম কোনও আত্মীয়ের হাতে সে-পুরস্কার বিতরণ করছেন স্বয়ং রাষ্ট্রপতি। খবরটা দুঃখের, কিন্তু অপরিচিত নয় । কিন্তু এই সংবাদসূত্র ধরেই যে পৌঁছে যাওয়া যায় সম্পূর্ণ নতুন স্বাদের এক উপন্যাসের কেন্দ্রে, নতুন আলাে ফেলে যে দেখে নেওয়া যায় ভারতের নানান প্রদেশের মানুষজনের হৃদয়-মন ও পারস্পরিক সম্পর্কের চেহারা তথা জটিলতাকে, আবিষ্কার করা যায় দেশকালের সীমানা-ছাপানাে আবহমান মানুষের অভিন্নতা ও অন্তঃসংহতির চিরকালীন জায়গাটিকে, তা কি জানা ছিল? সেই অভিনবত্বের দীপ্তিতেই ঝলমলে উপন্যাস, ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’। একালের যথার্থ জনপ্রিয় ও ব্যাপক বৈচিত্র্যসন্ধানী কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের কুশলী কলমে পরম কৌতূহলকর এক কাহিনী। কোথায় কোভালমের কে বাসুদেবন, কোথায় কলকাতার অর্ণব বসু । কোথায় দ্বারকার বিমলা যােশী, কোথায় গুয়াহাটির নীলকান্ত বড়ুয়া। কোথায় কটক, কোথায় গ্যাংটক। কোথায় লক্ষ্ণৌ আর কোথায়-বা শিমুলতলা । কিন্তু ভৌগােলিক এই দূরত্বকে ঘুচিয়ে দিয়েছে আটটি পরিবারের অসমসাহসী আটজন কিশাের-কিশােরী। একসঙ্গে তাদের নামে ঘােষিত হয়েছে জাতীয় পুরস্কার। রাষ্ট্রপতির হাত থেকে সেই পুরস্কার গ্রহণের আমন্ত্রণ পেয়ে একসঙ্গে দিল্লিতে এসে একই জায়গায় মিলিত হয়েছে আট রাজ্যের আটটি পরিবার। পুরস্কার কি মানুষের প্রাণের বিকল্প? গৌরব কি ঢেকে দিতে পারে শােক? দুঃখ-শােক দ্বিধা-বিহ্বলতায় অস্থির এই আটটি পরিবারের সামনে এমন বহু প্রশ্ন। এই আট পরিবারেরই একজন হয়ে মিশে গিয়েছেন যেন লেখক সমরেশ মজুমদার। শুনিয়েছেন, প্রতিটি পরিবারের বীর কিশাের-কিশােরীর প্রাণ-বিসর্জনের রােমাঞ্চময় ঘটনা। অন্যদিকে, খুব সূক্ষ্মভাবে জীবিত মানুষগুলির উপর আলাে ফেলেছেন তিনি। দেখে নিতে চেয়েছেন প্রতিটি পরিবারের তথা প্রতিটি মানুষের যথার্থ চেহারাটিকে। বড় করুণ, বড় নিষ্ঠুর, অথচ একইসঙ্গে বড় অবিকল সেই উদ্ঘাটন।
১৯৪২ সালের ১০ই মার্চ পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে জন্ম বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক এবং ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদারের। তাঁর শৈশব কাটে প্রকৃতির কোলে, চা বাগানে ঘুরে, আদিবাসী শিশুদের সাথে খেলে। এ কারণেই সমরেশ মজুমদার এর বই সমগ্রতে বারবার উঠে আসে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি, চা বাগান, বৃষ্টি কিংবা পাহাড়ের কথা। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় জলপাইগুড়ির জেলা স্কুল থেকে। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি কলকাতা স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। গ্রুপ থিয়েটারের প্রতি তাঁর ছিল ভীষণ ঝোঁক। মঞ্চনাটকে চিত্রায়নের উদ্দেশ্যে তিনি সর্বপ্রথম ‘অন্তর আত্মা’ নামের একটি গল্প রচনা করেছিলেন। সেই গল্পে নাটক মঞ্চায়িত না হলেও পশ্চিমবঙ্গের পাক্ষিক সাহিত্য পত্রিকা দেশ-এ প্রকাশিত হয় গল্পটি। সেই থেকেই শুরু তাঁর লেখকজীবন। সমরেশ মজুমদার এর বই বাংলাদেশের প্রচুর মানুষ পড়েন, পড়তে ভালোবাসেন। দুই বাংলাতেই তিনি সমান জনপ্রিয়। তিনি ঔপন্যাসিক হিসেবে বিখ্যাত হলেও, ছোটগল্প, কিশোর উপন্যাস, নাটক, চিত্রনাট্যসহ, গোয়েন্দাকাহিনীও রচনা করেছেন। সমরেশ মজুমদার এর বই সমূহ, যেমন- সাতকাহন, গর্ভধারিণী, মৌষকাল, ট্রিলজি- উত্তরাধিকার-কালবেলা-কালপুরুষ, আট কুঠুরি নয় দরজা ইত্যাদি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তাঁর সৃষ্ট চরিত্র অনিমেষ, মাধবীলতা, দীপাবলী আর জয়িতা পাঠকমনে আজও বিরাজমান। সাহিত্যে তাঁর অনন্য এবং অসামান্য অবদানের জন্য তিনি বিভিন্ন সময়ে আনন্দ পুরস্কার, সত্য আকাদেমী পুরষ্কার, বঙ্কিম পুরস্কার এবং আইআইএমএস পুরস্কার অর্জন করেছেন।