"বহে জলবতী ধারা- ১ম খণ্ড" বইটিতে লেখা ফ্ল্যাপের কথাঃ জীবন বহমান, জলবতী ধারার মতোই; কিন্তু মানুষের। জীবনের একটা আশ্চর্য ব্যাপার হলো, সে শুধু বহেই চলে না, নিজের গতিপথের দিকে তাকাতেও পারে, একই সঙ্গে একটা। জীবন যাপন করা আর সেই যাপিত জীবনের স্মৃতিরচনা করা সম্ভব হয় মানুষের পক্ষে। আর সেই জীবনটা যদি হয় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মতো কর্মকীর্তিময় মানুষের, তাহলে তা হয়ে ওঠে আরও বর্ণাঢ্য, আরো বিরাট এক অনুভূতিময় আবেগদীপ্ত ব্যাপার। ‘বহে জলবতী ধারা প্রথম খণ্ডে রয়েছে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের শৈশবের স্মৃতিচারণ—করটিয়া, জামালপুর, পাবনা, বাগেরহাটের নিসর্গ আর সভ্যতায় জড়াজড়ি করা রহস্যময় পথিবী—সেই সঙ্গে ঢাকা ও কলকাতার নাগরিক জীবনের উত্তেজনা ও কল্লোল; আর এ সবকিছুর ওপর দিয়ে মুগ্ধতা। ছড়িয়ে রাখা তার ভেতরকার অনিঃশেষ বিস্ময়বোধ। একটা শিশু বেড়ে উঠছে তার সময়কালস্থানের পটভূমিতে, তার চারপাশে আছে নানা চরিত্র, তার কলেজ শিক্ষক আব্বা, মূল্যবোধ সম্পন্ন শিক্ষকেরা, উনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি রেনেসাঁসের উত্তরসূরি সংস্কৃতিবান হিন্দু সম্প্রদায়, নবজাগ্রত। মুসলমান, স্কুলের বন্ধু, মা-ভাইবোনের প্রাণবন্ত পারিবারিক জীবন, মায়ের মৃত্যুবেদনা, গ্রামের জীবনের দুঃখকষ্ট, রাজনৈতিক উত্তেজনা এমনি অনেক কিছু । একেকবার সে বড় হয়ে হতে চাইছে একেক কিছু, কখনও খেলোয়াড়, কখনও গুণ্ডা, কখনও কবি, কখনও দার্শনিক। কখনও পিতার মতোই আদর্শবাদী শিক্ষক, কখনো ট্রেনের ড্রাইভার, কখনো চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট—কোনটা তার নিয়তি জানা নেই। কিন্তু এসবের থেকেও এই বইয়ের যা বড় সম্পদ। তা হল জীবন-নদীর তীরে দাড়িয়ে এসব কিছুকে তাঁর। নিবিষ্টভাবে দেখে যাওয়া—শুধু চোখের দেখা নয়, বিশদভাবে। দেখা, শিল্পীর চোখ দিয়ে, কবির চোখ দিয়ে, প্রেমিকের চোখ। দিয়ে, দার্শনিকের চোখ দিয়ে দেখা—আর তাকে ব্যাখ্যা। করা, বর্ণনা করা । অসাধারণ তার ভাষাশৈলী, সজীব ও প্রাণবন্ত তার বর্ণনাভঙ্গি, অথচ একই সঙ্গে রসবোধে টইটুম্বুর । একদিকে দার্শনিকের প্রজ্ঞা অন্যদিকে কবিত্বের সৌন্দর্য আর শক্তিতে প্রসাদগুণসম্পন্ন এই বইটিতে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ লিখে। রাখছেন তার সময় আর স্বদেশ আর স্বগ্রহের বিশ্বস্ত বয়ান, লিখে রেখে যাচ্ছেন একমহতী উপন্যাসের মতো দেশকালের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তিমানুষের বেড়ে ওঠার ব্যক্তিগত কাহিনী—জীবন সম্পর্কে এক অভিজ্ঞ মানুষের ব্যাখ্যা। সবটা মিলিয়ে এই গ্রন্থ আমাদের সময়ের একটি শ্রেষ্ঠ বই হিসেবে। সমাদৃত হবে কালের পাঠশালায়—এই আশা মোটেও বেশি কিছু নয়।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একইসাথে একজন খ্যাতিমান সাহিত্যিকও। আর সমাজ সংস্কারের বিভিন্ন বিষয়ের সাথে জড়িয়ে থাকায় একজন সমাজ সংস্কারক হিসেবেও পরিচয় লাভ করেছেন তিনি। এই বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব কলকাতার পার্ক সার্কাসে ১৯৩৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস বাগেরহাট জেলার কামারগাতি গ্রাম। পাবনা জিলা স্কুল থেকে তিনি মাধ্যমিক এবং বাগেরহাটের প্রফুল্লচন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। এরপর উচ্চশিক্ষার্থে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন এবং পরবর্তীতে এখান থেকেই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। কর্মজীবনে একজন শিক্ষক হিসেবে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। ঢাকা কলেজ, রাজশাহী কলেজসহ বিভিন্ন কলেজে তিনি অধ্যাপনা করেছেন। টেলিভিশনে বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপস্থাপনার মাধ্যমে টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। আর ষাটের দশকে বাংলাদেশে সাহিত্যের এক নতুন ধারা সৃষ্টির আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন তিনি তাঁর সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে, এবং একইসাথে 'কণ্ঠস্বর' নামক একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করে নতুন ঐ সাহিত্যযাত্রাকে করেছিলেন সংহত ও বেগবান। শুধু তা-ই নয়, দেশের মানুষের মাঝে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলে তাদের মাঝে জ্ঞান ও শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়ে তাদের আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে ১৯৭৮ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন 'বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র', যা চল্লিশ বছরেরও অধিক সময় ধরে কাজ করে যাচ্ছে এই লক্ষ্যে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এর বই সমূহ এই ব্যাপারে বিশেষ অবদান রেখেছে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এর বই সমগ্র এর মধ্যে 'ভাঙো দুর্দশার চক্র', 'আমার বোকা শৈশব', 'নদী ও চাষীর গল্প', 'ওড়াউড়ির দিন', 'অন্তরঙ্গ আলাপ', 'স্বপ্নের সমান বড়', 'উপদেশের কবিতা', 'অপ্রস্তুত কলাম' ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সাহিত্য, শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি 'বাংলা একাডেমি পুরস্কার', 'একুশে পদক', 'র্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার' ইত্যাদি সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।