প্রাবন্ধিক হিসাবে আবদুল হকের ছিল তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা। গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও ইতিহাসচেতনার ফলে 'অতীতের উপলব্ধি এবং ভবিষ্যতের ইঙ্গিত'কে তিনি একযোগে ধারণ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু তাই বলে তাঁর মনকে পূর্বতন সংস্কারের দ্বারা আচ্ছন্ন হতে দেখা যায় নি। বিজ্ঞান-মনষ্কতা তাঁর বিচারবোধকে শাণিত রেখেছে বলেই অতীত ও বর্তমানের ঘটনাবলিকে তিনি দেখতে পেরেছেন বস্তুনিষ্ঠভাবে। এ-ধরনের গুণাবলি-সম্পন্ন মানুষ আমাদের সাহিত্য অঙ্গনে চিরকালই কম। তার ওপর আবদুল হক একটু বেশিরকম অন্তর্মুখি ছিলেন বলে হয়তো তাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল আরও একটু নিভৃতিপরায়ণ। ফলে আমাদের সমাজের কমসংখ্যক মানুষের দৃষ্টিসীমায় আসতে পেরেছিল তাঁর কর্ম। কিন্তু আমাদের বিদ্যুৎমণ্ডলীতে তিনি ছিলেন যথেষ্টই শ্রদ্ধেয়। বর্তমান উৎকেন্দ্রিকতার ডামাডোলের ফলে তিনি কিছুটা বিস্মৃতির আড়ালে পড়ে গেছেন। স্বাধীনতা-উত্তরকালে অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীকেই দেখা গেছে কোনো-না-কোনোভাবে দলীয় রাজনীতির অনুসারী হয়ে পড়তে। দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সৎ উপলব্ধি ও বিচারবুদ্ধিকে পাশ কাটিয়ে অনেক সময় তাঁদের ভাষ্য উপস্থাপন করতে হয়েছে। এঁদের ভিড়ে আবদুল হক ছিলেন উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক ইত্যাদি বিচিত্র মাধ্যমেই তিনি সৃষ্টিশীল ছিলেন। তবে সংখ্যা, বৈচিত্র্য এবং প্রভাবের দিক থেকে তাঁর প্রবন্ধকার-সত্তাই পেয়েছিল ব্যাপকতর পরিচিতি। তাঁর সামগ্রিক সাহিত্যিক-সত্তার গুরুত্ব যথার্থভাবে অনুভব করতে হলে তাঁর কেবল প্রাবন্ধিক-সত্তাই নয় নাট্যকার ও গল্পকার-সত্তাকেও বিবেচনা করা জরুরি।
কথাসাহিত্যিক নাট্যকার ও অনুবাদক আবদুল হক (১৯১৮-১৯৯৭) গত শতাব্দীর বিশের দশকের বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের উত্তরসূরি; প্রাবন্ধিক হিসেবেই সমধিক পরিচিত। স্মৃতিকথা ও দিনলিপির নির্বাচিত অংশ এবং ছড়ানাে ছিটানাে ব্যক্তিগত রচনা মিলিয়ে সম্পন্ন হয়ে উঠেছে তাঁর এই আত্মজীবনী। এতে সংগ্রামশীল সাহিত্য-নিমগ্ন একজন মননশীল ব্যক্তিমানুষকেই খুঁজে পাওয়া যায়! এখানেও তিনি বিজ্ঞানমনস্ক ও মুক্তিবুদ্ধিরই মানুষ। রয়েছে প্রাবন্ধিকসুলভ তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, গভীর অন্তর্দৃষ্টি আর ইতিহাস চেতনার পরিচয়। আপাত অর্থে নিজের কথা বললেও তা কেবল ব্যক্তিবিশেষের আত্মকথন না হয়ে হয়ে উঠেছে। বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজের মানসবিবর্তনের ইতিহাস। আত্মজীবনীমূলক রচনা মহৎ হয়ে ওঠে আত্মস্বীকারােক্তিতেও, কারণ এর লেখক নিজের একজন মূল্যায়নকারীও বটেন! এই আত্মজীবনীও এর ব্যতিক্রম নয়। যে-সব মানুষের সম্পর্কে এখানে মন্তব্য রয়েছে তাতেও রয়েছে অনুকম্পায়ী হৃদয়ের মােহমুক্ত বিচার! ঘটনার নিকটদূরত্বে থেকে লেখা হলেও এই রচনা হয়ে উঠেছে আশ্চর্য নির্মোহতার নিদর্শন!