"আল মাহমুদ রচনাবলি ১ - ১৩খণ্ড" বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ নিজের জীবনকালে যে লেখক তার সমগ্র রচনাবলির প্রকাশ দেখে যেতে পারেন তার চেয়ে ভাগ্যবান আর কে? আল্লাহর রহমতে আমার সে সৌভাগ্যও হলাে। আমার রচনাবলির প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হলাে। যে বইটি দিয়ে প্রথম খণ্ড শুরু হচ্ছে সেটা আমার প্রথম রচনা না হলেও কবি বা লেখক জীবনেরই কৈশােরক চালচিত্র মাত্র। একজন কবির বেড়ে ওঠার কাহিনি যেভাবে বেড়ে উঠি। একসময় এই বইটি পাঠকের মধ্যে বেশ আলােড়ন তুলেছিল। যারা আমার রচনার ভক্ত তাঁরা এই বইটিকে বেশ একটু গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। আর যারা আমার সহযাত্রী কবি বন্ধু এবং সমান বয়েসী তাদের বক্তব্য হলাে পঞ্চাশ দশকের বাংলাদেশের কবিদের একটাই আত্মজীবনী, আর তাহলো যেভাবে বেড়ে উঠি। প্ৰথম খণ্ডের সংযােজন আমার নিজের নয়। এর সমস্ত কৃতিত্ব ‘ঐতিহ্য’-এর আরিফুর রহমান নাইমের। বলাবাহুল্য সংযােজন তালিকাটি আমারও পছন্দ। আগুনের মেয়ে’ একটি অস্বাভাবিক নারী চরিত্রের কল্পিত কাহিনি নিয়ে রচিত উপন্যাস। বইটি বেরুলে যেমন আমার খানিকটা প্রশংসা জোটে তেমনি আমাকে নানা প্রশ্নবাণেও বিদ্ধ করা হয়। এমন কথাও বলা হয়, আধুনিক কবি লেখকরা আজকাল প্লট খুঁজে হয়রান হয়ে জিনপরী নিয়েও গল্প লিখতে শুরু করেছে। আমার বক্তব্য হলে আমরা মুসলমান ধর্মীয় কারণেই জিনের অস্তিত্বে আস্থাশীল। আর যাতে আমাদের আস্থা তা নিয়ে সাহিত্যসৃষ্টিও সম্ভব। ‘আগুনের মেয়ে' বইটিও পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। এই খণ্ডে ‘ময়ূরীর মুখ' গল্পের সংকলন যুক্ত হয়েছে। আমার সাহিত্যচর্চার একটা প্রধান বিষয়ই হয়ে উঠেছিল ছােটগল্প। যদিও আমার গল্পের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম। কিন্তু আমার গল্প ছিল আমার মূল বিষয় কবিতারই পরিপূরক। আজও গল্পসৃষ্টির তাগাদা আমার মধ্যে উদ্যম জাগায়। এই খণ্ডে আমার একটি প্রধান কাব্যগ্রন্থ ‘কালের কলস রয়েছে। কবিতা নিয়ে আমার আর বলার কী আছে? তবে সারা জীবন কবিতার পেছনে ছােটার একটা সামান্য বিবরণ আছে আমার বিলাত ভ্রমণের একটি ক্ষুদ্র পুস্তিকায় ‘কবিতার জন্য সাত সমুদ্র’।
বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবিদের একজন আল মাহমুদের কবিতার বই পড়েননি এমন সাহিত্যপ্রেমী খুঁজে পাওয়া ভার। গুণী এই কবি একাধারে একজন সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক। তবে সবকিছু ছাপিয়ে গেছে তার কবি পরিচয়। আধুনিক বাংলা কবিতা নানা দিক থেকে তার কাছে ঋণী থাকবে। বাচনভঙ্গি আর রচনাশৈলীতে তার কবিতা সমকালীন যেকোনো কবির তুলনায় অনন্য। ‘কবিতাসমগ্র’ (দুই খন্ড) ‘উড়ালকাব্য’, ‘সোনালি কাবিন’, ‘আল মাহমুদের স্বাধীনতার কবিতা’, ‘প্রেমের কবিতা সমগ্র’, ‘আল মাহমুদের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ ইত্যাদি কবিতার বই নিয়ে আল মাহমুদ কবিতাসমগ্র। এছাড়াও আল মাহমুদ উপন্যাস সমগ্র প্রকাশিত হয়েছে তিন খণ্ডে। জাতীয় রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক টানাপোড়েন, স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমি ও প্রেক্ষাপটসহ সমাজ ও ব্যক্তি জীবনের দ্বন্দ্ব স্থান পেয়েছে আল মাহমুদ এর বই সমূহ-তে। ‘কালের কলম’, ‘লোক লোকান্তর’, ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’, ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’, ‘আরব্য রজনীর রাজহাঁস’, ‘গল্প সমগ্র’, ইত্যাদি তার উল্লেখযোগ্য লেখা। আল মাহমুদের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে। তার পুরো নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। শিক্ষাজীবনেই তিনি লেখালেখির সাথে সম্পৃক্ত হন। রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল আর মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলী পাঠ করতে করতে নিজের কবি প্রতিভা আবিষ্কার করেন তিনি। ১৯৫৪ সালে সাপ্তাহিক কাফেলা পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। কিছুকাল পরই এ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। পুরো ৬০-এর দশক জুড়ে তিনি অসংখ্য কবিতা রচনা করেন এবং কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা ও খ্যাতি লাভ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি প্রবাসী সরকারের হয়ে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এ পত্রিকায় সরকার বিরোধী লেখালেখির কারণে এক বছরের জন্য কারাদণ্ডও ভোগ করতে হয় তাকে। ১৯৭৫-৯৩ সাল পর্যন্ত শিল্পকলা একাডেমির পরিচালক হিসেবে কাজ করে কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন। কবি আল মাহমুদ তার অনবদ্য রচনাশৈলীর জন্য ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’, ‘একুশে পদক’, ‘জীবনানন্দ স্মৃতি পুরস্কার’, ‘নাসির উদ্দিন স্বর্ণপদক’ সহ অসংখ্য পদক ও সম্মাননা লাভ করেছেন। ২০১৯ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি তিনি পরলোকগমন করেন।