ভূমিকা সিংহল থেকে ফিরে কিছু কাল তিনি উদ্যানে ছিলেন। তাঁর বিহার যখন আগুনে পুড়ে গিয়েছিল, সম্ভবত তখনই তিনি সাহায্য লাভের আশায় পাঁচ জন সঙ্গী নিয়ে হিমালয়ের উত্তরে যাত্রা করেছিলেন। হিমালয়ের উপর দুটি রাস্তা ছিল—একটি মানুষের, অন্যটি দানবের। নরেন্দ্রযশ যখন বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর সঙ্গীদের মধ্যে এক জন পথভ্রষ্ট হয়ে দানবের পথে চলে গিয়েছেন তখন তিনি তাড়াতাড়ি সে দিকে ছুটে গিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, দানবরা ততক্ষণে তাঁর সেই সঙ্গীকে মেরে ফেলেছিল। নরেন্দ্রযশ মন্ত্রশক্তির বলে নিজেকে তাদের হাত থেকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন। পরে আবার এক ডাকাতের দল তাঁদের ঘিরে ফেলেছিল। সে বারও তিনি মন্ত্রবলে উদ্ধার পেয়েছিলেন। পূর্ব দিকে যখন অবারদের দেশে গিয়ে পৌঁছেছিলেন তখন সেখানে তুর্কদের বিদ্রোহ চলছিল। পশ্চিম দিকে গিয়ে উদ্যানে ফেরার সম্ভাবনা ছিল না। সেই কারণে উত্তরের দিকে যেতে যেতে শেষে তিনি নীলসমুদ্রের ধারে গিয়ে পৌঁছেছিলেন। এই নীলসমুদ্র তুর্কদের দেশ থেকে সাত হাজার লি (সওয়া দু হাজার মাইলেরও বেশি) দূরে। সে দেশে শান্তি ছিল না, তাই ৫৫৮ খৃষ্টাব্দে চিনের উত্তরে ছিবংশের রাজধানী য়েহ্-এ গিয়েছিলেন। সেখানে সম্রাট বেন্-শ্বে তাঁকে অভ্যর্থনা করে থিয়েন্-পিঙ্ বিহারে থাকার সুবন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন, চিনা ভাষায় অনুবাদ করার জন্য রাজকুলের সমুদয় সংস্কৃত হস্তলিপি তাঁর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। অনুবাদের কাজে সাহায্যের জন্য সম্রাট চিনের কয়েক জন বিদ্বান বৌদ্ধ পণ্ডিতকে তাঁর হাতে সমর্পণ করেছিলেন। চিনে আসার কিছু দিন পরই সম্রাট তাঁকে বৌদ্ধসংঘের উপনায়কের পদ প্রদান করেছিলেন। তারপর প্রধান নায়কের। তাঁর পদ থেকে যে আয় হত তার বেশির ভাগই তিনি ভিক্ষু, দরিদ্র আর বন্দিদের আহার এবং পশুদের ঘাসবিচালির জন্য খরচ করতেন। সর্বজনীন হিতের জন্য তিনি অনেক কুয়ো কাটিয়েছিলেন। সেই সব কুয়ো থেকে তিনি নিজে জল তুলে তৃষ্ণার্তের তৃষ্ণা নিবারণ করতেন। নারী আর পুরুষের জন্য তিনি চিকিৎসালয় স্থাপন করেছিলেন। সেখানে সমস্ত রকম প্রয়োজনীয় সামগ্রী পাওয়া যেত। চিন্-জুনে পশ্চিমপর্বতের উপর তিনি তিনটি বিহার নির্মাণ করিয়েছিলেন। তুর্কদের সরাইতেও তিনি যেতেন। তাদের অনুরোধ করতেন, “মাসে অন্তত ছ'টা দিন নিরামিষ আহার করো, খাওয়ার জন্য ছাগল মেরো না।” এমনি নানা পুণ্যকর্ম তিনি করেছিলেন। এক বার তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন । তখন স্বয়ং সম্রাট আর সম্রাজ্ঞী তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন। এই সম্মান খুব কম লোকের ভাগ্যেই ঘটে। ডঃ পা চাউয়ের লেখা থেকে নরেন্দ্রযশের ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা করা যায় । সমস্ত দোষত্রুটি সত্ত্বেও যদি আমরা এই গ্রন্থের মাধ্যমে সেই মহান যাত্রীকে স্মরণ করি তবেই আমি আমার এই পরিশ্রম সার্থক মনে করব। পরিশেষে একটি কথা, আমার সব ঐতিহাসিক উপন্যাসই মুখ্যত উপন্যাস, ইতিহাস কিংবা জীবনী নয় ।
তাঁর জন্ম ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে সনাতন হিন্দু ভূমিহার ব্রাহ্মণ পরিবারে। জন্মস্থান উত্তর প্রদেশের আজমগড়ের একটি ছোট্ট গ্রাম। তাঁর আসল নাম ছিল কেদারনাথ পাণ্ডে। ছোটোবেলাতেই তিনি মাকে হারান। তাঁর পিতা গোবর্ধন পান্ডে ছিলেন একজন কৃষক। বাল্য কালে তিনি একটি গ্রাম্য পাঠশালায় ভর্তি হয়েছিলেন। আর এটিই ছিলো তাঁর জীবনে একমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। অষ্টম শ্রেণী অবধি অধ্যয়ন করেছিলেন। এখানে তিনি উর্দু ও সংস্কৃতের উপর প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। তিনি বহু ভাষায় শিক্ষা করেছিলেন যথা : হিন্দি, উর্দু, বাংলা, পালি, সংস্কৃত, আরবি, ফারসি, ইংরেজি, তিব্বতি ও রুশ।
পুরস্কার তালিকা পদ্মভূষণ (১৯৬৩) সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার (১৯৫৮)
ব্যক্তিগত জীবন জালিওয়ানওয়ালা বাগের হত্যাকান্ড (১৯১৯) তাঁকে একজন শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী কর্মীতে রূপান্তরিত করে। এ সময় ইংরেজ বিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে তাকে আটক করা হয় এবং তিন বছরের কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। এ সময়টিতে তিনি পবিত্র কুরআন শরীফ সংস্কৃতে অনুবাদ করেন। পালি ও সিংহল ভাষা শিখে তিনি মূল বৌদ্ধ গ্রন্থগুলো পড়া শুরু করেন। এ সময় তিনি বৌদ্ধ ধর্ম দ্বারা আকৃষ্ট হন এবং নিজ নাম পরিবর্তন করে রাখেন রাহুল (বুদ্ধের পুত্রের নামানুসারে) সাংকৃত্যায়ন (আত্তীকরণ করে যে)।, জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি বিহারে চলে যান এবং ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ-এর সাথে কাজ করা শুরু করেন। তিনি গান্ধিজীর আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন এবং এসময় তিনি গান্ধীজী প্রণীত কর্মসূচীতে যোগদান করেন। যদিও তাঁর কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ছিলো না, তবুও তার অসাধারণ পান্ডিত্যের জন্য রাশিয়ায় থাকাকালীন লেনিনগ্রাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে শিক্ষকতার অনুরোধ করা হয়। তিনি তা গ্রহণ করেছিলেন। ভারতে এসে তিনি ডঃ কমলা নামক একজন ভারতীয় নেপালি মহিলা কে বিয়ে করেন। তাদের দুই সন্তান হয়, কন্যা জয়া ও পুত্র জিৎ। পরে শ্রীলংকায় (তৎকালীন সিংহল) বিদ্যালঙ্কার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এখানে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে দার্জিলিংয়ে, ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দের ১৪ এপ্রিল তারিখে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।