"নির্বাচিত কিশোর কবিতা"বইটির ভূমিকা: নজরুল ইসলামের বাইশ বছরের সৃষ্টিশীল জীবন বাংলাসাহিত্যকে যে সুবিশাল প্রাচুর্য এবং সমৃদ্ধি দিয়েছে তা বিস্ময়কর। জীবদ্দশায় তাঁর বই প্রকাশিত হয়েছে চল্লিশটির মতাে। এর মধ্যে শিশু-কিশােরদের উপযােগী রচনার পরিমাণও খুব একটা কম নয়। কিন্তু দুঃখজনক যে, তাঁর শিশু-কিশােরদের জন্য লেখা বইগুলাে আজ দুষ্প্রাপ্য। অথচ রচনা-বৈশিষ্ট্যে, শিশুর জগৎ সৃষ্টির ক্ষমতায় নজরুল ইসলামের রচনাসমূহ বিশেষভাবে তাৎপর্যমণ্ডিত। নজরুল ইসলামের সমস্ত সৃষ্টির মধ্যেই আছে একধরনের প্রাণােচ্ছলতার দীপ্তি । শিশু-কিশােরদের জন্য লেখা তাঁর সৃষ্টিসমূহেও এই প্রাণােচ্ছলতার উদ্ভাস লক্ষ করা যায় যা শিশু-কিশােরদের মনােজগতের এক প্রধান ও মৌলিক অনুষঙ্গ। এর ফলে নজরুলের রচনাসমূহ শিশু-কিশােরদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠতে পেরেছে। পাঠ্যপুস্তক কিংবা অন্যান্য মাধ্যমে নজরুলের গুটিকয় শিশুকবিতা আজ সাধারণ পাঠকমহলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেলেও নজরুলের এমন অনেক লেখা রয়েছে যা কোনও অংশেই তার অধিক প্রচারিত লেখাগুলাের চেয়ে উৎকর্ষের দিক থেকে কম নয়। নজরুল ইসলাম ব্যক্তি হিসেবে ছিলেন অগােছালাে। কেউ কেউ তাঁকে নিন্দা করেছেন, কেউ কেউ তাকে ব্যবহার করেছেন পণ্য হিসেবে; যথাযােগ্য মর্যাদা পায়নি তাঁর সৃষ্টিকর্ম। পরিণামে আমরা দেখি তার অনেক বিখ্যাত রচনার মূল পাঠ, এমনকি তাঁর অনেক উৎকৃষ্ট রচনাও এ-যুগের সাধারণ পাঠকের কাছে এসে পৌছােয়নি। বিষয়বস্তুর গভীরতা এবং সৃষ্টিশীলতার বৈচিত্র্য না থাকলে একজন লেখক কিংবা শিল্পীর পক্ষে দীর্ঘকাল ধরে জনপ্রিয় হয়ে থাকতে পারা খুব সহজ নয়। নজরুল ইসলামের জনপ্রিয়তাকে সে-কারণে খাটো করে দেখা যায় না, তাঁর সৃষ্টিসমূহে এমন কিছু নিশ্চয়ই রয়েছে যা তাঁকে আজ পাঠক-হৃদয় সংবেদ্য করে রেখেছে। নজরুল ইসলামের শিশু-কিশােরােপযােগী লেখাগুলাের মধ্যে রয়েছে বৈচিত্র্যময় এবং বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত অনেক অনিন্দ্য জগৎ। তাঁর শিশু-কিশােরােপযােগী লেখায় স্পষ্টভাবে রয়েছে দেশপ্রেম, ধর্মচেতনা, শ্রেয়ােচেতনা, ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলমানের একাত্ম হওয়ার স্বপ্ন, কল্পনার, স্বপ্নের এবং উজ্জীবনের উদ্ভাস, লােকঐতিহ্য-চেতনা এবং নির্মল হাস্যরসের বিচিত্র ভুবন।
১৮৯৯ সালের ২৪ মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার, অভিনয়শিল্পী, সুরকার ও প্রবন্ধকার। নজরুলের বাল্যকাল কেটেছে দুঃখ-দুর্দশায়। তাই তাঁর ডাকনাম ছিলো দুখু মিয়া। তাঁর বৈচিত্র্যময় শিক্ষাজীবন শুরু হয় গ্রামের মক্তবে। পিতৃহীন হওয়ার পর তিনি পড়ালেখা ছেড়ে যোগ দেন লেটোর দলে, যেখান থেকে তিনি কবিতা ও গান রচনার কৌশল রপ্ত করেন। পরবর্তীতে এক বছর ময়মনসিংহের দরিরামপুর হাই স্কুলে পড়ে পুনরায় চুরুলিয়ায় রানীগঞ্জের শিয়ারসোল রাজ স্কুলে ভর্তি হন, এবং সেখানে তিন বছর অধ্যয়ন করেন। প্রবেশিকা পরীক্ষার আগেই তাকে পড়ালেখা ছাড়তে হয় যুদ্ধে যোগদানের জন্য। যুদ্ধের দিনগুলোতে নানা জায়গায় অবস্থান করলেও তার করাচির সৈনিকজীবনই উল্লেখযোগ্য, কেননা সেসময়েই তার প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায় ‘বাউণ্ডেলের আত্মকাহিনী’ নামক গল্প প্রকাশের মাধ্যমে। কাজী নজরুল ইসলাম এর বই সমূহ’র বিষয়বস্তু বিবিধ। তবে কাজী নজরুল ইসলাম এর বই-এ সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক যন্ত্রণা এবং সাম্যবাদের ধারণা প্রকটভাবে স্থান করে নিয়েছে। রাবীন্দ্রিক যুগে তার সাহিত্য প্রতিভা উন্মোচিত হলেও তার সৃষ্টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কাজী নজরুল ইসলাম এর বই সমগ্র এর মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো ‘রিক্তের বেদন’, ‘দোলনচাঁপা’, ‘বিষের বাঁশি’, ‘সাম্যবাদী’, ‘সর্বহারা’, ‘প্রলয়শিখা’ ইত্যাদি। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী নজরুল ‘সাপ্তাহিক লাঙল’, দ্বিসাপ্তাহিক পত্রিকা ‘ধূমকেতু’র সম্পাদক ছিলেন। বাংলাদেশের জাতীয় কবি এবং বাংলা সাহিত্যের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ২৯ আগস্ট ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।