দেখা হ’ল না ক্ষিতীশদার সাথে : সেদিনটা ৩০শে নভেম্বর, ১৯৭৩। গিয়েছিলাম দুর্গাপুর আর.ই. মডেল স্কুলের শিক্ষক আবাসনে । আমার দাদাস্থানীয় বন্ধু এবং এই স্কুলের শিক্ষক ক্ষিতীশ চ্যাটার্জীর সাথে দেখা করতে। তখন সকাল ৯টা থেকে ৯-৩০ হবে। ক্ষিতীশদা ছিলেন না। ক্ষিতীশদা তখন সবে জীবনের একটা পর্ব শেষ করে আর একটা শুরু করেছেন। জেল থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষকতা শুরু করেছেন। তিনি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে অঙ্কে মাস্টার ডিগ্রি করার সময়েই 'আরও বাম' রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন। সি.পি.এম. রাজনীতি করতে করতেই পার্টির ওপর আস্থা হারান এবং আবদুল হালিম (ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠাতাদের একজন) মারা যাবার দিন কয়েক বাদে বীরভূমের নগরী গ্রামে আরও কয়েকজনের সাথে আবদুল হালিমের স্মরণ সভায় শপথ নেন ভারতবর্ষের বিপ্লবের অসমাপ্ত কাজ তাঁরাই করবেন । সেটা ১৯৬৬ সাল। আবদুল হালিম মারা যান ৬৬ সালের ২৯শে এপ্রিল। ঐ সভায় যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে চারটে নাম আমি জানি। মানিক চট্টরাজ, লাভপুরের কাছে ঠিবা গ্রামের রাধানাথ চট্টরাজের ছেলে। ক্ষিতীশ চ্যাটার্জী, সিউড়ির দক্ষিণে চাতরা গ্রামের ছেলে। সিউড়ির দীপ্তি রায় এবং আবদুল হালিমের ছেলে বিপ্লব হালিম। বিপ্লব যদিও তখন কলকাতার বাসিন্দা কিন্তু ওদের দেশের বাড়ি কীর্ণাহার। যাই হোক, এদের কাউকেই তখন আমি চিনি না। পরবর্তীকালে একমাত্র দীপ্তি রায় বাদে বাকিদের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়। দীপ্তি রায়কে আমি খুব সম্ভবতঃ এখনও চিনি না। ৬৬ সালে একমাত্র মানিকা ছাড়া ওদের সকলেরই বয়স ছিল ২০/২২ এর মধ্যে ৷ মানিকদাই তখন একটু বড় এবং নগরী স্কুলে মাস্টারি করেন । এরা সকলেই বীরভূম জেলার বিভিন্ন গ্রামের ছেলে। পড়াশুনা শেষ করেছে বা করবার মুখে। সংসারের দায়িত্ব কারও উপর পড়েনি তখনো। এরা মার্কসবাদ পড়ে, সি. পি. এম করে, বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে, দীর্ঘস্থায়ী জনযুদ্ধ, হঠাৎ অভ্যুত্থান এবং সন্ত্রাসবাদী পথের মিশ্রণে এক রোমান্টিক দর্শনে বুঁদ হয়ে থাকে। মনে রাখতে হবে ৬৬ সালের এপ্রিল মে মাসে তখনো নকশালবাড়ি ঘটতে দেরি আছে এক বছর। নকশালবাড়ির স্ফুলিঙ্গ জ্বলেছিল ১৯৬৭-র ২৪শে মে। সি. পি. আই ভেঙে সি. পি. এম-এর জন্ম হয়েছে সবে দেড় বছর। সি. পি. এম-এর জন্ম ৭ই নভেম্বর ১৯৬৪। ৬৭-র ২৪শে মে নকশালবাড়ি ঘটার পর সি. পি. আই (এম. এল) জন্ম নেয় ১৯৬৯-এর ২২শে এপ্রিল। যাক, এদের কথায় পরে আসবো আবার। এখন যেখান থেকে এদের কথায় চলে এলাম, সেখানেই ফেরা যাক। ১৯৭৩ সালের ৩০শে নভেম্বর সকাল ৯টা/৯-৩০টায় আমি আর.ই. মডেল স্কুলের শিক্ষক আবাসনে গিয়ে ক্ষিতীশদাকে পেলাম না। আমি বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে চাইছিলাম না। কারণ, ক্ষিতীশদা সবে জেল থেকে বেরিয়েছে। আমার সাথে তার যোগাযোগ জানাজানি হ'লে, আবার তার বিপদ হতে পারে। এইখানে বলে রাখা দরকার যে বীরভূমের ৭০ আন্দোলনকে ঘিরে গ্রেফতারের সংখ্যা প্রায় ২৫০০। তার মধ্যে আমিই শেষের আগের জন। শেষ গ্রেফতার তাঁতিপাড়ার শ্যামল রায়, '৭৪- এর জানুয়ারিতে। অবশ্য এটাও ঠিক যে অন্ততঃ ৫/৭ জন গ্রেফতারই হয়নি কোনো দিন। আমাদের আঞ্চলিক কমিটির সম্পাদক ৭৫/৭৬ পর্যন্ত এলাকাতেই ছিলেন কিন্তু গ্রেফতার হননি। যাই হোক, ক্ষিতীশদা নেই।