"আসরারে খুদি" বইয়ের সংক্ষিপ্ত কথা: উড়ে এসে জুড়ে বসা- প্রবাদটার প্রয়োগক্ষেত্র নিয়ে ঢের বিতর্ক হতে পারে। তথাপি আল্লামা ইকবালের জন্য এরচেয়ে মানানসই বিশেষণ বোধ হয় নেই। তৎকালীন ভারতে জন্ম নেয়া পাকিস্তানের এই জাতীয় কবি স্বদেশীয় উর্দু বা হিন্দি ছেড়ে বিদেশি ফারসি ভাষা শুধু দখল করেই ক্ষান্ত হননি; রীতিমতো বাদশাহি করে গেছেন। যার অনন্য নজীর 'আসরারে খুদি'। ভারতের যে দুজন কবি সার্থকভাবে ইউরোপে ছায়া ফেলতে পেরেছেন, তাঁদের একজন ইকবাল। তার কারণ এই "আসরারে খুদি"। মূলত প্রেম আর আত্মাই এর বিষয়বস্তু। ১৯১৫ সালে প্রকাশিত 'আসরারে খুদি' ইকবালের দীর্ঘজীবনের কাব্যচর্চা আর দর্শন শিক্ষার সফল প্রয়োগ। প্রস্তাবনা এবং শেষের প্রার্থনাসহ ১৯টি অধ্যায়ে বিভক্ত। আত্মা, আত্মার শক্তি, আত্মার দুর্বলতা, আত্মশাসন প্রভৃতি গুরুগম্ভীর বিষয়ের ব্যাখ্যা অত্যন্ত সাবলীল এবং ঘটনাময় হয়ে বর্ণিত হয়েছে এখানে। প্রেমিক ইকবাল প্রস্তাবনাতেই বলেছেন- 'আমি একজন প্রেমিক, উচ্চ নিনাদ আমার ধর্ম; রোজ কেয়ামতের চিৎকার আমার কাছে তোষামোদ'। পাঠকের কাছে বলেছেন-' আমার সুরাপাত্র দেখে দোষ দিও না, বরং অন্তর দিয়ে সুরার স্বাদ গ্রহণ করো'। ইকবালের মতে বিশ্বের গতিধারার মূল উৎস আত্মা। বলা হয়েছে "জীবন যখন আত্মা থেকে শক্তি গ্রহণ করে, জীবন নদী তখন বিস্তৃত হয় মহাসমুদ্রের বিশালতায় "।এজন্য স্বপ্ন দেখানোতেই তাঁর সর্বাধিক গুরুত্ব। "আকাঙ্ক্ষাই চিরজাগ্রত রাখে আত্মাকে, আত্মার মহাসমুদ্রে আকাঙ্ক্ষাই হচ্ছে অশান্ত ঢেউ"। প্রেমই হচ্ছে আত্মাকে শক্তিশালী করার প্রকৃত পথ। ইকবালের মতে, "প্রেম দ্বারাই আত্মা অধিকতর স্থায়ী হয়, হয় অধিকতর জীবন্ত আর উজ্জ্বল। আত্মার অজ্ঞাত সম্ভাবনা প্রেমেই পূর্ণতা পায়।" তাই প্রেমের কাছে কোনোকিছুই অপরাধ নয়। অন্যদিকে ভিক্ষা আর অনুগ্রহ প্রত্যাশার কারণে আত্মা হয়ে পড়ে দুর্বল। ইকবালের মতে, " ভিক্ষার দ্বারা যদি একটা মহাসমুদ্রও অর্জন করো, তা শুধু আগুন সমুদ্রই। স্বহস্তে উপার্জিত হলে একবিন্দু শিশিরই পরম মধুময়"। ইকবাল বুঝাতে চেয়েছেন, আত্মবিশ্বাসের অভাব হলেই জাতির অধঃপতন ঘটে। শত্রু কখনো শাসক হলে নৈতিক শিক্ষাদানের নামে মূলত জাতির আত্মবিশ্বাসটাই কেড়ে নেয়। প্লেটো প্রভাবিত মুসলিম দর্শন থেকে বেড়িয়ে এসে তিঁনি সুফিতত্ত্বের অগ্রপথিক রুমির (১২০৭-১২৭৩) প্রতিই ঝুঁকে পড়েন। ইকবালের উপদেশ," নিজেকে নিক্ষেপ করো জ্বলন্ত বালুরাশির উপর, যেনো তুমি যোগ্য হতে পারো জীবনযুদ্ধের। দেহ ও আত্মা দুইই দগ্ধ হোক জীবন-অনলে। তাই বলে নিয়মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেননি ইসলাম দ্বারা প্রভাবিত ইকবাল। আত্মশাসন দ্বারা পরিশুদ্ধ মনই কেবল বিশ্বকে শাসন করতে পারে বলে তাঁর দৃঢ় ঘোষণা। তাঁর আহবান, "জাগ্রত হও, বাজিয়ে তোলো ভ্রাতৃত্বের সুর, শান্তির বাণী পৌঁছে দাও তাদের কানে; যারা যুদ্ধ চায়"। সত্য পথ কীভাবে পাওয়া সম্ভব? এর উত্তরে পরবর্তী অধ্যায়েই বলেছেন, "খুলে দাও তোমার চক্ষু, কর্ণ আর মুখ; তারপরেও যদি সত্যের দেখা না পাও, আমায় গালি দিও"। আত্মবিশ্বাসকে বরাবরই উচ্চস্থানে রাখতে চেয়েছেন তিঁনি। একাদশ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, "যদি পথিক নিজেকে দুর্বল মনে করে, তবে মূলত দস্যুর হাতেই নিজেকে সমর্পণ করে"। শত্রু সম্পর্কে ইকবালের ধারণা, "শত্রুই তোমার বন্ধু। তার অস্তিত্বই তোমাকে গৌরবের মুকুট পরায়"। পাশাপাশি আত্মমর্যাদাবোধ হারানোর বিরুদ্ধে তিঁনি। "হীরক হয়ে ওঠো, শিশিরবিন্দু নয়। একমুহূর্তের জন্যও আত্মসংরক্ষণে অবহেলা করো না।" ইসলামের নামে সাম্রাজ্যবাদনীতি গ্রহণের বিরোধী ইকবাল। তাঁর ব্যাখ্যা মতে, "জেহাদের উদ্দেশ্য যদি রাজ্যলোভ হয়, তবে তা ইসলাম সমর্থন করে না"। খুব দৃঢ়তা নিয়ে বলেছেন, "মুসলিম যদি প্রেমিক না হতে পারে, তবে সে কাফের"। এই অধ্যায়ের শেষেই বলা হয়েছে," ভিক্ষুকের ক্ষুধা গ্রাস করে তাঁর আত্মাকে, কিন্তু সুলতানের ক্ষুধা ধ্বংস করে রাজ্য আর ধর্ম"। বর্তমান সময়ের মুসলিম নেতৃত্বে তিঁনি অসন্তুষ্ট। তাঁর খেদোক্তি থেকেই বুঝা যায়, "ওগো বন্ধু, কী করবো আমরা? পীর আমাদের ফিরিয়েছে মুখ মদ্যশালার দিকে"।