ফ্ল্যাপে লিখা কথা ইতালির আলবার্তা মোরাভিয়াকে বলা হয় ‘চিরকালের সবুজ লেখক’ । ইতালিয়ান সাহিত্যে তাঁর মতো আলোচিত,বিতর্কিত , আন্তর্জাতিক লেখক দ্বিতীয় কেউ নেই। তাঁর রচনা যৌনতার অভিযোগে ইতালিতে নিষিদ্ধ ছিল প্রায় কুড়ি বছর (১৯৪৩-১৯৬৩)। ফ্যাসিস্ট লা ডুচ মুসোলিনী ও খ্রিস্ট মৌলবাদের সূতিকাগার ভ্যাটিকান এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ফ্যাসিবাদী শাসক তাঁকে ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যাও দেয়। চরম যৌনতার অভিযোগে অভিযুক্ত হন তিনি।
মোরাভিয়া ছিলেন নিওরালিস্টিক বা নববাস্তবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ লেখক। যুদ্ধ পরবর্তীকালে ইতালির রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থার নির্মম খড়গ নেমে আসে নিওরালিজমের ওপর। সেসময় মোরাভিয়া ও তাঁর কর্ম প্রচণ্ড বাধা ও তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। পশ্চিমা অধিকাংশ রক্ষণশীল লেখক-সমালোচক ‘যৌনতা’ শব্দটি তাঁর নামের সঙ্গে বেশ ভালোবাসে সেঁটে দিয়েছেন। এ জন্যেই সম্ভবত আমাদের অনুবাদকরা মোরাভিয়ার রচনাগুলো ব্যাপকভাবে ভাষান্তরের ক্ষেত্রে মুখ ফিরিয়েছেন। যে জন্যে এদেশের পাঠক মহলে তাঁর রচনা যতোটা পরিচিত, আদরণীয় বা বর্জনীয় , নন্দিত বা নিন্দিত হতে পারতো, বলতে গেলে তা একেবারেই হয়নি। অথচ বিশ্বের বহু ভাষাভাষী পাঠক মহলে মোরাভিয়া নিন্দিতের চেয়ে অধিক নন্দিত এবং পাঠকপ্রিয় লেখক। কোনো লেখকের ক্ষেত্রে ‘জনপ্রিয়’ শব্দটি বাজারি সাহিত্যে ধান্দবাজির এক কৌশল। আলবার্তো মোরাভিয়াই ইতালির একমাত্র লেখক যাঁর রচনা এ পর্যন্ত বিশ্বের ২৯ টি ভাষায় ভাষান্তরিত হয়েছে।
যুদ্ধের পর সাম্যবাদী চেতনার এই লেখক কয়েক বছর সংযুক্ত ছিলেন ইতালিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে । কিন্তু ১৯৫৬ সালে রুশ সেনারা যখন অন্যায় , অনমানবিকভাবে হাঙ্গেরিয়ানদের ওপর হত্যা ও নিপীড়ন চালায়, তার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে মোরাভিয়া কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেন। ফ্যাসিস্টদের গুণ্ডামি আর কমিউনিস্টদের ভণ্ডামি দ্বারা মোরাভিয়া যেমন নিঃগৃহীত হয়েছেন দীর্ঘদিন, তেমনি রোমান ক্যাথলিক গির্জার হাতেও অপদস্থ হয়েছেন অনেকগুলো বছর। পরবর্তীকালে তাঁর রচনায় সেক্সের বিষয়টি আরো ব্যাপকভাবে লাভ করে। কিন্তু তখন ইতালির মানুষের কাছে তাঁর লেখালেখিতে যৌনতার অকপট বর্ণনা ও দোষ ত্রুটি ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে তাঁর মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমাজের নিচু শ্রেণির মানুষের প্রতি তাঁর অসীম মমত্ববোধের বিষয়টি।
মোরাভিয়ার প্রায় সব গল্প, উপন্যাস রোমের নগরকেন্দ্রিক যান্ত্রিক জীবনের বিচিত্র কাহিনি ও চরিত্রকে নিয়ে লেখা। একমাত্র মোরাভিয়া রচনাতেই ইতালিয় সমাজের আসল রূপটা প্রস্ফুটিত হয়েছে । ইতালিয়ান কোনো লেখকের কলমে এমন নিখুঁত মনস্তাত্বিক যৌন বিশ্লেষণ পাওয়া যাবে না।
এ গ্রন্থে মোরাভিয়ার ব্যাপক আলোচিত তিনটি উপন্যাস ‘রিটার্ন টু দ্য সি’ (সাগর সঙ্গমে, ‘দ্য টু অব আস্’ (ফুলের বয়স) এবং ‘ডিজায়ার টু এনজয়’ (মিলন বাসনা) অত্যন্ত নিষ্ঠা ও সচেতনতার সঙ্গে বাংলায় চমৎকার ভাষান্তর করেছেন কবি-কথাশিল্পী ওয়াহিদ রেজা। যথাযথ অনুবাদ বলতে যদি অবিকৃত স্বীয় ভাষান্তর বোঝায় , তাহলে এখানে তার কোনো কার্পণ্য বা অবহেলা করা হয় নি।