কুসুমকে মনে আছে আপনাদের? পুতুল নাচের ইতিকথার সেই কোমলে-কঠোরে মেশানো 'তেইশ বছরের বাঁজা' মেয়েটিকে? বড় আকর্ষণীয়, বড় মনোরম আর রহস্যময় এক চরিত্র এঁকেছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। বুঝতে চেয়েছি তাকে, আর তার প্রায়- দুর্বোধ্য আপাত-রহস্যময় আচরণগুলোকে। শশীর সঙ্গে কী সম্পর্ক তার? প্রেম? ভালোলাগা? সমর্পণ? নাকি ছলচাতুরি? পরের বউ সে, তবু, নানা কৌশলে শশীর কাছে যায়, কত যে দুষ্টুমি-খুনশুটি, অভিমান-অনুযোগ, এমনকি নিজের কঠোর আচরণে অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাওয়ার জন্য শশীর ঘরে গিয়ে হাজির হয়। আর দাওয়ায় বসে থাকা বাবা দেখবেন বলে একলা ঘরে দরজা আটকে দেয়ার সাহস দেখায়, জরুরি কথা বলার ছলে তালপুকুরে ডেকে নিয়ে যায়, আরো কত কি! এইসব 'খেলা' (!) চলে দশবছর ধরে, তবু কেন কিছু বলে না সে, মুখ ফুটে, পরিষ্কার করে? নাকি ভুল বললাম? একেবারেই কি বলেনি? 'এমনি চাঁদনি রাতে আপনার সঙ্গে কোথাও চলে যেতে সাধ হয় ছোটবাবু।'- বলেনি? আর কবে কোন নারী নিজেকে এমন অপূর্বভাবে নিবেদন করেছে তার প্রেমিকের কাছে? কিন্তু কথাটি শোনার পর- 'গভীর দুঃখের সঙ্গে শশীর মনে হয়, এ কথা কুসুমের বানানো...' (এবং আরো অনেক আজেবাজে ভাবনা)।' সাড়া না পেয়ে অতঃপর কুসুম আবার বলে- 'আপনার কাছে দাঁড়ালে আমার শরীর এমন করে কেন ছোটবাবু?' শরীর! শরীর!
শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, নিয়তিবাদ ইত্যাদি বিষয়কে লেখার মধ্যে তুলে এনে বাংলা সাহিত্যে যিনি অমর হয়েছেন, তিনি হলেন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯০৮ সালের ১৯ মে বিহারের সাঁওতাল পরগনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, আর মানিক ছিলো তাঁর ডাকনাম। বাবার বদলির চাকরিসূত্রে তাঁর শৈশব, কৈশোর ও ছাত্রজীবন কেটেছে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, যার ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের পটভূমিতে বিভিন্ন সাহিত্য রচনা করেছেন তিনি। প্রবেশিকা ও আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গণিত বিষয়ে অনার্স করতে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এখানে পড়াশোনাকালে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে তিনি 'অতসী মামী' গল্পটি লেখেন। সেই গল্পটি বিখ্যাত 'বিচিত্রা' পত্রিকায় ছাপানো হলে তা পাঠকনন্দিত হয় এবং তিনি সাহিত্যাঙ্গনে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি সাহিত্য রচনায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন, যার ফলে তাঁর পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং তিনি আর পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। তাঁর হাতে বাংলা সাহিত্যে এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয় ঐ সময়ে, যখন সারা পৃথিবী জুড়ে মানবিক বিপর্যয়ের এক চরম সংকটময় মুহূর্ত চলছে। কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকে যাওয়ায় তাঁর লেখায় একসময় এর ছাপ পড়ে এবং মার্ক্সীয় শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র। ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণেরও প্রভাব লক্ষ্য করা যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র-তে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে 'পদ্মানদীর মাঝি', 'দিবারাত্রির কাব্য', 'পুতুলনাচের ইতিকথা', 'শহরতলি', 'চতুষ্কোণ', 'শহরবাসের ইতিকথা' ইত্যাদি বিখ্যাত উপন্যাস, এবং 'আত্মহত্যার অধিকার', 'হারানের নাতজামাই', 'বৌ', 'প্রাগৈতিহাসিক', 'সমুদ্রের স্বাদ', 'আজ কাল পরশুর গল্প' ইত্যাদি গল্পগ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা রচনার কিছু নিদর্শন থাকলেও সেগুলো তেমন উল্লেখযোগ্যতা অর্জন করেনি। অসামান্য এই কথাসাহিত্যিক মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।