বিশ্বের প্রবন্ধ সাহিত্যের ইতিহাসে ডেল কার্নেগী এক স্মরণযােগ্য নাম। তাঁর লেখা গ্রন্থাবলী আজও আমরা আগ্রহের সঙ্গে পাঠ করে থাকি। আসলে প্রবন্ধকার হিসাবে তার সব থেকে বড় বৈশিষ্ট্য হল তিনি শুধুমাত্র তাত্ত্বিক আলােচনার মাধ্যমে তাঁর প্রবন্ধাবলী শেষ করেননি। প্রতিটি প্রবন্ধের সাথে ব্যবহারিক জীবনের একাধিক ঘটনা সংযুক্ত হয়েছে। তাই এই প্রবন্ধগুলি পড়লে মনে হয় আমি বুঝি আমার নিজের জীবনের ছবি দেখতে পাচ্ছি। ডেল কার্নেগী রচনার আর একটি বড় বৈশিষ্ট্য, তিনি সবসময় হতাশ মানুষকে আশাদীপ্ত হতে বলেছেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন ইতিবাচক মনের মানুষ। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, পারিপার্শ্বিকতার কারণেই মানুষের স্বপ্নগুলি সফল হয় না। এর জন্য তাকে দোষ দিয়ে কোনাে লাভ নেই। তিনি চেষ্টা করতেন কীভাবে ওই প্রতিবন্ধী পারিপার্শ্বিকতাগুলােকে অপসারণ করা যেতে পারে। তাই আজও তার লেখা আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক হয়ে আছে। সেই সাহিত্যকেই আমরা কালােত্তীর্ণ বলবাে, যা কালের যাত্রাপথে ক্ষয়িষ্ণু হয় না। যুগ-যুগান্তরে নিজেকে নতুন করে প্রতিভাত করতে পারে। একথা অস্বীকার করার বিন্দুমাত্র উপায় নেই যে, ডেল কার্নেগী যখন এইসব প্রবন্ধগুলি লিখেছিলেন তখন পৃথিবীর বাতাবরণ যেমন ছিল এখন অনেকটা তার থেকে পালটে গেছে। এখন মানুষ আগের থেকে আরও বেশি যন্ত্রনির্ভর হয়ে উঠেছে, এটাই স্বাভাবিক। শুধু তাই নয়, নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্ক থেকে শুরু করে চিরন্তন ধ্যান ধারণা, সবক্ষেত্রেই ঘটে গেছে নিঃশব্দ বিপ্লব। তবু আজও আমরা চরম কৌতুহলের সঙ্গে ডেল কার্নেগীর রচনাবলী পাঠ করে থাকি এবং নতুন করে উদীপ্ত হই। গৃহহীনভাবে গভীর বনে জন্মগ্রহণ করে আমেরিকার প্রসিডেন্ট হয়ে হােয়াইট হাউসে পর্দাপন করেন আব্রাহাম লিঙ্কন। দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসে সর্বোচ্চ স্থানে অবস্থান করা এই সংগ্রামী মানুষ আব্রাহাম লিঙ্কনকে নিয়ে ডেল কার্নেগী রচনা করেন তার জীবনকথা। চিরকাল ডেল কার্নেগীর পথ-প্রদর্শক ছিলেন এই মহান প্রসিডেন্ট। পাঠকও এই মহান ব্যক্তির জীবনী পাঠ করে উদীপ্ত হবেন আশা রাখি।
ডেল ব্রাকেনরিডজ কার্নেগী, এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে ২৪ নভেম্বর, ১৮৮৮ সালে জন্ম নেওয়া এই আমেরিকান লেখক তাঁর আত্ম-উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ পদ্ধতি ও বইয়ের পাতায় আজও বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় এক নাম। সেলফ-ইম্প্রুভমেন্ট, সেলসম্যানশিপ, করপোরেট ট্রেনিং, পাবলিক স্পিকিং, ও ইন্টার পার্সোনাল স্কিল এর মতো দারুণ সব প্রশিক্ষণের উদ্ভাবন ও এসব বিষয়ে লেখা ডেল কার্নেগী এর বই সমূহ আশার আলো দেখিয়েছে অসংখ্য হতাশাচ্ছন্ন মানুষকে। মিসৌরিতে দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম নেওয়ার দরূণ বালক বয়স থেকেই কাজ করেছেন ক্ষেতখামারে। এর মাঝেও ওয়ারেন্সবার্গের সেন্ট্রাল মিশৌরি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছেন। কলেজ শেষে জীবিকার তাগিদে বেকন, সাবান এবং লার্ড (শূকরের চর্বি মিশ্রিত করা) তৈরির কাজও করতে হয় আর্মর অ্যান্ড কোম্পানির জন্য। ফার্মের প্রধান হিসেবে অনেক সাফল্য লাভ ও ৫০০ ইউএস ডলার সঞ্চয়ের পর ১৯১১ সালে বহুদিনের লালিত স্বপ্ন অধ্যাপক হওয়ার জন্য বিক্রয় সেবার কাজটি ত্যাগ করেন তিনি। কিছু ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা ঝুলিতে নিয়ে যখন ওয়াইএমসিএ- এর ১২৫ নম্বরে বাস করতে শুরু করেন, তখনই পাবলিক স্পিকিং এর ধারণাটি মাথায় খেলা করে কার্নেগীর। সেই সময় মোট লভ্যাংশের ৮০% শতাংশের বিনিময়ে ওয়াইএমসিএ এর পরিচালকের কাছে শিক্ষা প্রদানের আগ্রহ প্রকাশ করেন। এভাবেই ১৯১২ সাল থেকে কার্নেগী কোর্সের যাত্রা শুরু হয়। পুরো আমেরিকাবাসীর কাছে ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির পথ হয়ে উঠে তার পদ্ধতি। ডেল কার্নেগী এর বই সমগ্র এর মধ্যে ‘হাউ টু উইন ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ইনফ্লুয়েন্স’ বইটিকে তার সেরা অবদান হিসেবে ধরা হয়। প্রথম প্রকাশের মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই যার ১৭তম মুদ্রণও প্রকাশ করতে হয়েছিলো। ডেল কার্নেগী এর লেখাগুলো বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। ‘বিক্রয় ও জনসংযোগ প্রতিনিধি হবেন কীভাবে’, ‘বন্ধুত্ব ও সম্পদ লাভের কৌশল’, ‘বড় যদি হতে চাও’, ‘ব্যক্তিত্ব বিকাশ ও সাফল্যের সহজ পথ’ এমন নানা নামের অনূদিত ডেল কার্নেগী বাংলা বই অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে বাংলাভাষী পাঠকদেরও। ডেল কার্নেগী শ্রেষ্ঠ রচনাসমগ্র এর মধ্যে আরও আছে ‘দ্য বায়োগ্রাফি অব আব্রাহাম লিংকন’, ‘ফাইভ মিনিট বায়োগ্রাফিস’ এবং ‘বিশ্বায়নের পটভূমি’। ১ নভেম্বর, ১৯৫৫ সালে আমেরিকান এই অধ্যাপক মৃত্যুবরণ করেন।