রবীন্দ্রনাথের পত্রসাহিত্য পরিমাণে বিপুল। বিশ খণ্ডে গ্রন্থিত হয়েছে পত্রগুলি, আরও বহুপত্র অগ্রন্থিত রয়ে গেছে। য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র তাঁর প্রথম পত্রগ্রন্থ। উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি ১৮৭৮ সালে লন্ডনে যান। গ্রন্থে সেখানকার রসবাসের বিবরণ তুলে ধরেছেন, আর আছে যাত্রাপথের বর্ণনা। পত্রগুলির সংখ্যা মোট দশটি, অগ্রজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উদ্দেশ্য করে লিখিত। এই পত্রগ্রন্থটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই প্রথম রবীন্দ্রনাথ চলিত ভাষায় গদ্য রচনা করলেন। রবীন্দ্রনাথ পত্রগুলি লিখেছেন চলিত বাংলায়। তাঁর লেখনীর নৈপুণ্যে এটি সাহিত্যিক গদ্যের রূপ পেয়েছে, তুলে ধরেছে রবীন্দ্রনাথের শিল্পীস্বভাবের স্বকীয়তা। তার প্রকৃতিপ্রিয় মনের যেমন পরিচয় আছে তেমনি আছে ইংল্যান্ডের মানুষ, পরিবার-পরিজন, সমাজ-সংস্কৃতির প্রতি কবির মুগ্ধতা এবং সমালোচনাও। য়ুরোপের সামাজিক উৎসবে নরনারীর একত্রে আনন্দ-উৎসবের দৃশ্য তাঁকে অনুপ্রাণিত করে। তিনি ভারতীয় সমাজের নারীদের বন্দিদশার সঙ্গে তুলনাও করেন। যে বয়সে পত্রগুলি লেখা সে সময়টা ছিল কবির গড়ে-ওঠার কাল, জীবনজগতের সঙ্গে পরিচয়কে লেখনীতে তুলে আনার নবিশি-পর্যায়, যা তিনি নৈপুণ্য আর সাহিত্যিক ভাষায়-গুণে সম্পন্ন করতে পেরেছেন। আমরা য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র গ্রন্থে তত্বকালীন ইংলন্ডের সমাজচিত্র, সংস্কৃতি ও শিক্ষার পরিবেশ সম্পর্কে জানতে পারি। পত্রগুলি অত্যন্ত গতিশীল অন্তর্বয়ন ও পাঠের আনন্দদায়ক বিধায় তা পাঠকের কাছে সমাদৃত হয়েছে।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, চিত্রশিল্পী, সংগীতস্রষ্টা, অভিনেতা, কন্ঠশিল্পী, কবি, সমাজ-সংস্কারক এবং দার্শনিক। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য প্রথম বাঙালি হিসেবে ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে তৎকালীন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে কলকাতার ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিমনা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ভানুসিংহ ঠাকুর ছিল তাঁর ছদ্মনাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই মানেই এক মোহের মাঝে আটকে যাওয়া, যে মোহ পাঠককে জীবনের নানা রঙের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয় নানা ঢঙে, নানা ছন্দে, নানা সুর ও বর্ণে। তাঁর ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাট্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর কিছুদিন পরই আলোর মুখ দেখে। কাবুলিওয়ালা, হৈমন্তী, পোস্টমাস্টারসহ মোট ৯৫টি গল্প স্থান পেয়েছে তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থে। অন্যদিকে ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ১,৯১৫টি গান। উপন্যাস, কবিতা, সঙ্গীত, ছোটগল্প, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনীসহ সাহিত্যের সকল শাখাই যেন ধারণ করে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমূহ। তিনি একাধারে নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা দুই-ই ছিলেন। কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া তিনি চিত্রাংকনও করতেন। তৎকালীন সমাজ-সংস্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমগ্র। তাঁর যাবতীয় রচনা ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে ত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। আজও আমাদের বাঙালি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে বিশ্বকবির সাহিত্যকর্ম।