‘কৃষ্ণপক্ষ’ বইটিতে ফ্ল্যাপে লেখা কিছু কথাঃ অরু ও মুহিব বর্তমান প্রজম্মের দুই তরুণ তরুণী। হৃদয় জুড়ে আছে তাদের অকৃত্রিম ভালোলাগা ও ভালোবাসা। তাইতো একে অপরের কাছে এসেছে প্রকৃতির নিয়মে খুব সহজেই।টুকরো টুকরো আনন্দময় কিছু মুর্হুত তাদের জীবনে ছিল। সময়ের স্রোতে এগিয়ে গেছে তারা স্থির সিন্ধান্তের দিকে। কিন্তু নাহ্। তারা পারেনি। বিবাহিত জীবন শুরু করেও পারেনি সুখময় দাপম্পত্য জীবন গড়ে নিতে। অকস্মৎ এক দুর্ঘটনায় মুহিব বিদায় নেয় এই মায়াময় পৃথিবী থেকে। স্বভাবতই অরুর জীবনে নেমে আসে এক ভয়াবহ বিচ্ছিন্নতা। কিন্তু অরুকে তবুও বাঁচতে হবে। বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে পারিবারিক নির্দেশে সে আবার ঘর বাঁধে। সময়ও দ্রুত এগিয়ে চলে। সে হয় জননী। দীর্ঘ পঁচিশ বছর পর তার প্রথম মেয়ের বিয়েতে দুই যুগ পূর্বের নির্দিষ্ট স্মৃতি তাকে হঠাৎ অসুস্থ করে তুললো। ছোট মেয়ে কান্তার একটা কথা।আপা দুলাভাইয়ের পাঞ্জাবী আগুন দিয়ে পুড়াচ্ছে।‘বন ফায়ার হবে’ অরুর চোখে জল এসে যাচ্ছে তিনি সেই জল সামলাবার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন।........ কৃষ্ণপক্ষ হুমায়ূন আহমেদের সাম্পতিক সময়য়ের হৃদয়ছোঁয়া এক প্রেমের উপন্যাস। এই উপন্যাস সম্পর্কে লেখক নিজেই ‘অত্যন্ত প্রিয়’ লেখা হিসেবে উল্লেখ করেছে।
“নিঃসঙ্গ নক্ষত্র” বই এর ফ্ল্যাপ : সন্ধ্যার ম্লান হয়ে আসা আলোয় অনু বলল, ‘এই যে আমার জন্য এমন করে কাদছ, এই যে আমাকে এমন করে চাইছ, আমি চাই এই কান্নাটা সারাজীবন থাকুক, এই চাওয়াটাও। পেয়ে গেলে চাওয়াটা আর থাকে না। কে জানে, হয়তো পাওয়াটাও নয়। আমার কি মনে হয় জানো? ‘কি? ‘পুরোপুরি পেয়ে যাওয়া মানে পুরোপুরি হারিয়ে ফেলা। মাহফুজ কথা বলল না, চুপচাপ অনুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। অনু বলল, ‘এই যে তোমাকে এত পেতে ইচ্ছে করে, এর চেয়ে। তীব্র কিছু আর নেই এ জগতে । কিন্তু জানো কি, পেয়ে যাওয়ার পর পেতে চাওয়ার এই তীব্র ইচ্ছেটা আর থাকে না। তোমারও থাকবে না। আজকের এই মুহুর্তটাকে তখন মনে হবে জীবনের সবচেয়ে যুক্তিহীন, সবচেয়ে ভুল একটি মুহূর্ত। এই তীব্র চাওয়ার অনুভূতিগুলো তখন ধীরে ধীরে মরে যেতে থাকবে। মরে যেতে যেতে একসময় পুরোপুরি নিঃশেষ হয়ে যাবে। তখন সবকিছু কেবল অভ্যাস হয়ে থাকে, অনুভূতি নয়। অনু একটু থামলো তারপর আবার বলল, ‘আমি চাই না তুমি আমার অভ্যাস হয়ে যাও, আমি চাই তুমি আমার অনুভূতি হয়েই থাকো। তখন সূর্যের শেষ আভাটুকুও মিলিয়ে যাচ্ছিল দিগন্তে। সেই আভাটুকুর দিকে তাকিয়ে অনুর যেন মনে হলো সে তার বুকের বা দিকটার ভার বহন করতে পারছে না।
“নিঃসঙ্গ নক্ষত্র” বই এর ভূমিকা: ‘এই ঘটনা সত্য, না মিথ্যা? ‘মিথ্যা’। মিথ্যা ঘটনা লিখেছেন কেন? ‘সরি, এটা আসলে সত্য ঘটনা। ‘সত্য ঘটনা এমন হয়? এমন কেন? এই প্রশ্নে আমি চুপ করে থাকি, আমার কষ্ট হয়। আসলেই কী জীবন এমন? হয়তো এমনই, হয়তো এমন নয়। তবে আমি সবসময়ই বলি, ‘জীবনে যেমন গল্প থাকে, তেমনি গল্পেও থাকে জীবন। সেই সব গল্পের কতটুকুই আমাদের জানা থাকে? আমরা কতজন কত কত নিঃসঙ্গ দিন-রাত্রির গল্প বুকে পুষে কাটিয়ে দেই একাকি জীবন, সেই জীবনের খবর কে রাখে? হয়তো সেই নিঃসঙ্গ মানুষটি ছাড়া আর কেউ-ই না। ‘নিঃসঙ্গ নক্ষত্ৰ’ তেমনি গল্প কিংবা জীবন। এই গল্পটা কী কোথাও শুনেছি আমি? আমার ধারণা আমি শুনেছি। গল্পের মেয়েটার মুখ থেকেই শুনেছি এবং মেয়েটিকে চিনিও আমি। কিন্তু গল্পটা কী একটু অন্য রকম হয়ে গেল? নাকি আরো খানিকটা অন্যরকম হতে পারতো? অনু কী জানতে পারতো না, জীবন কেবল এমন নয়, জীবন হতে পারে আরো অন্যরকমও? কলম অবশ্য বলে গেল, কেউ জানে না জীবন কেমন, জীবনের রকম কী! তা কেবল জীবনই জানে। তাই সে লিখে গেল জীবন। সেই জীবন সত্য না মিথ্যা, তা ধরতে পারে সাধ্য কার! ‘নিঃসঙ্গ নক্ষত্র’ সেই সত্য-মিথ্যার জীবন।
‘ক্রাচের কর্নেল' ফ্ল্যাপে লেখা কিছু কথাঃ যাদুর হাওয়া লাগা অনেকগুলো মানুষ, নাগরদোলায় চেপে বসা একটি জনপদ, ঘোর লাগা এক সময়, একটি যুদ্ধ, একজন যুদ্ধাহত কর্নেল, কয়েকটি অভ্যুত্থান। উপন্যাস ‘ক্রাচের কর্নেল; বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে নাটকীয় কালপর্বের অনন্যসাধারণ গাঁথা।
‘জেনারেল ও নারীরা’ বইয়ের ফ্ল্যাপের কথাঃ পাকিস্তানের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ছিল অসংখ্য প্রেমিকা। ওই সময় রাষ্ট্রপতি ভবনকে পাকিস্তানের পুলিশেরাই অভিধা দিয়েছিল ‘পতিতালয়’। সরকারি রিপোর্টেই শত শত নারীর উল্লেখ পাওয়া যায়, যাঁরা ইয়াহিয়ার কাছে গিয়েছিলেন। রোম যখন পুড়ছিল, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল। আরেক রমণীমোহন পাকিস্তানি পুরুষ ভুট্টোর সঙ্গে মিলে ইয়াহিয়া, তাঁর দোসররা ও তাঁর বাহিনী লাখ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছে বাঙালিরা তাদের ন্যাঘ্য দাবি উত্থাপন করেছিল বলে। সেই অন্যায়ে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও তাঁর উপদেষ্টা কিসিঞ্জার। কিন্তু সবাই মিলেও তাঁরা রোধ করতে পারেননি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়।
গাভী বিত্তান্ত বইয়ের ফ্ল্যাপঃ লেখক অনেকেই হন, তবে মনীষী লেখক আমরা তাদেরকেই বলি যাদের রচনায় একই সঙ্গে যুগ ও যুগোত্তরের স্বপ্ন ও সাধনা মূর্ত হয়ে ওঠে। সেরকম এক বিরলদৃষ্ট মনস্বিতাসম্পন্ন লেখক। লিপিকুশলতার সঙ্গে মনীষার এমন মনিকাঞ্চন যোগ সচরাচর ঘটে না, সব লেখকের বেলায় তো নয়ই। ইতিহাস বোধ, ঐতিহ্য-সচেতনতা, মানবগ্ৰীতি, উধের্ব আমাদের কালের এক চিন্তানায়কের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। মৃত্যুজনিত শূন্যতা আমাদের মধ্যে এই বোধকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। তাঁর একমত ছিলেন না। এমনকি তাদের পক্ষেও তার চিন্তার প্রাতিস্বিকতা ও প্রতিভার মৌলিকত্বকে স্বীকার না করে উপায় ছিল না। একইভাবে আজ ও আগামী দিনেও তাঁর রচনার শরণাপন্ন আমাদেরকে হতে হবে। আহমদ ছফার গাভী বিত্তান্ত উপন্যাসটি একেবারে আনকোরা নতুন স্বাদের। বিষয়বস্তু যেমন নতুন প্রকাশভঙ্গিও তেমনি নতুনত্বের দাবিদার। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি নিয়ে লেখা এটি একমাত্র উপন্যাস। এই উপন্যাসে ফ্যান্টাসি এবং নিখাদ বাস্তবতা একে অপরের সঙ্গে এমনভাবে মিশে গিয়েছে যা শৈল্পিক নিরীক্ষার ক্ষেত্রে একটি নতুন পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হতে পারে। যদিও এটিকে প্রথম দৃষ্টিতে স্যাটায়ারিক উপন্যাস মনে হবে। তবুও অন্তলীন একটি বয়ে গেছে। এই অপরিসীম। বেদনা এবং মমত্তবোধের কারণে উপন্যাসটি কোথাও কোথাও সমুদ্রের গভীরতা অর্জন করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্পণে দেশ সমাজ এবং জাতিকে নিরীক্ষণের মহামূল্য প্রমাণ হিসেবেও রচনাটির গুরুত্ব সকলের মনোযোগের দাবি রাখে।
`মায়ের চিঠি’ বইয়ের ফ্ল্যাপের কথাঃ এক সন্তান তার মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে। সেই মা বৃদ্ধাশ্রমকে সন্তান প্রদত্ত জেল হিসাবে বরণ করে নেয়। একদিন মায়ের মনে হলো তার সন্তানকে বড় করতে অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছে। সবকিছু সন্তান জানে না। কোনোদিন বলাও হয়নি। কাগজ কলম নিয়ে সন্তানকে চিঠি লিখতে বসলেন। খোকা, তুমি কেমন আছ। তোমার প্রদত্ত জেলে আমি ভালো আছি...। আশ্রয়হীনদের আশ্রম। হাসি-কান্নার জীবনে এখানে। শুধু যৌবন অনুপস্থিত। এখানে সব আছে। তবুও কিসের যেন অভাব রয়েছে। বৃদ্ধাদের তপ্ত নিঃশ্বাসে এখানের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। বাতাসে কান পাতলে কান্নার ধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়... একজন মানুষ ৪৫ ইউনিট ব্যথা একবারে সহ্য করতে পারে। একজন মা সন্তান প্রসবের সময় ৫৭ ইউনিটের বেশি ব্যথা সহ্য করেন। তুমি কি ব্যথার মাত্রা বুঝতে পারছ? তোমাকে সামান্য উদাহরণ দেই। এই ব্যথা ২০টি হাড্ডি একসাথে ভেঙে যাওয়ার চেয়ে বেশি। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, তোমাকে জন্ম দিতে গিয়ে তোমার মায়ের কি পরিমাণ ব্যথা সহ্য করতে হয়েছে.. এক মায়ের অশ্রুজলে লেখা উপন্যাস।
‘সাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ’ বইয়ের কথাঃ এই কাহিনি একটি যুদ্ধের। সেই যুদ্ধের দেয়ালে নানা চলকের লুকোচুরি, দেশপ্রেমের ঢেউ আর বিশ্বাসঘাতকতার চোরাস্রোত, দাবার বোর্ডের গুটি হয়ে বহু মানুষের হাঁটা চলা।
বাংলা সাহিত্যের এক কিংবদন্তী হুমায়ূন আহমেদ। বিংশ শতাব্দীর বাঙালি লেখকদের মধ্যে তিনি অন্যতম স্থান দখল করে আছেন। একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার ও নাট্যকার এ মানুষটিকে বলা হয় বাংলা সায়েন্স ফিকশনের পথিকৃৎ। নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও তিনি বেশ সমাদৃত। বাদ যায়নি গীতিকার কিংবা চিত্রশিল্পীর পরিচয়ও। সৃজনশীলতার প্রতিটি শাখায় তাঁর সমান বিচরণ ছিল। অর্জন করেছেন সর্বোচ্চ সফলতা এবং তুমুল জনপ্রিয়তা। স্বাধীনতা পরবর্তী বাঙালি জাতিকে হুমায়ুন আহমেদ উপহার দিয়েছেন তাঁর অসামান্য বই, নাটক এবং চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রের বদৌলতে মানুষকে করেছেন হলমুখী, তৈরি করে গেছেন বিশাল পাঠকশ্রেণীও। তাঁর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমনি’ দেখতে দর্শকের ঢল নামে। এছাড়া শ্যামল ছায়া, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, ঘেটুপুত্র কমলা প্রভৃতি চলচ্চিত্র সুধীজনের প্রশংসা পেয়েছে। অনন্য কীর্তি হিসেবে আছে তাঁর নাটকগুলো। এইসব দিনরাত্র, বহুব্রীহি, আজ রবিবার, কোথাও কেউ নেই, অয়োময়ো আজও নিন্দিত দর্শকমনে। হিমু, মিসির আলি, শুভ্রর মতো চরিত্রের জনক তিনি। রচনা করেছেন নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার, জোছনা ও জননীর গল্পের মতো সব মাস্টারপিস। শিশুতোষ গ্রন্থ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক রচনা, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী মিলিয়ে হুমায়ূন আহমেদ এর বই সমূহ এর পাঠক সারাবিশ্বে ছড়িয়ে আছে। হুমায়ূন আহমেদ এর বই সমগ্র পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিতও হয়েছে। সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অর্জন করেছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮১), একুশে পদক (১৯৯৪), হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), মাইকেল মধুসূধন দত্ত পুরস্কার (১৯৮৭), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩ ও ১৯৯৪), বাচসাস পুরস্কার (১৯৮৮), শিশু একাডেমি পুরস্কার, জয়নুল আবেদীন স্বর্ণপদকসহ নানা সম্মাননা। হুমায়ূন আহমেদ এর বই, চলচ্চিত্র এবং অন্যান্য রচনা দেশের বাইরেও মূল্যায়িত হয়েছে৷ ১৯৪৮ সালের ১৩ই নভেম্বর, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলায় কুতুবপুরে পীরবংশে জন্মগ্রহণ করেন হুমায়ূন আহমেদ। কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনের বেলভ্যু হাসপাতালে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। গাজীপুরে তাঁর প্রিয় নুহাশ-পল্লীতে তাঁকে সমাহিত করা হয়।