জানে আলম বাংলা সাহিত্যে শুদ্ধা চিন্তার কবি হিসেবে পরিচিত। কবিতা লেখার পাশাপাশি তিনি ছড়া এবং শিশু কিশোর গল্পও লিখেছেন।তার ছড়া ও গল্পগুলো উপদেশ মূলকশিশুদের জন্য শিক্ষণীয়। মহৎ সাহিত্য রচনার কাজে তিনি নিবেদিত। তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ -নৈশব্দের কাছে যাবো, মেশকের মায়াবী ঘ্রাণ, কতোকাল আর ভালো থাকা,গোপনে কাঁদো গোপনেই মুছে ফেলো অশ্রু, আল্লাহর কাছে সব বলে দেবো। ছড়া গ্রন্থ -শুভেচ্ছা নাও সবুজ পাতা,সুখে থাকো বৃক্ষ আমার,মায়ার বাড়ী ইস্টিশন, বৃষ্টি ঝরে সুরে সুরে, আগুন ঝরা ফাগুন ছড়া, ছড়া শুধু কথা ছড়ায় গল্পগ্রন্থ -পাখির জন্য ভালোবাসা,আব্বু তুমি ভেরিগুড, আমার আছে দোয়েল কোকিল, সূতাকাটা ঘুরি। ফুলের হাসি ভালোবাসি।ইত্যাদি। তিনি শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন।
তাজ ইসলাম : কবি জানে আলম তার সময়ের অনেক সহযাত্রীর তুলনায় লেখালেখির জগতে যথেষ্ট সরব শব্দ সৈনিক। কাব্য চর্চার সহযোদ্ধারা এক সময় রুটি রুজির গ্যারাকলে পড়ে কাব্যাঙ্গন থেকে কেউ কেউ হারিয়ে যায়। কারো গতি হয়ে পড়ে শ্লথ। জানে আলম আছেন সক্রিয় এবং সৃজন কর্মে নিবেদিত। সাহিত্য চর্চার শুরু তার কবিতা দিয়ে। পরবর্তীতে অত্যন্ত দরদ আর আবেগসহ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রচনা করে যাচ্ছেন শিশুসাহিত্য।
"মায়ার বাড়ি ইস্টিশন " তার রচিত শিশুতোষ ছড়া কাব্য। ইতিমধ্যে তার ২১ টি গ্রন্থ প্রকাশ হয়েছে। জানে আলমের ছড়া গ্রন্হের যাত্রার শুরুতেই তার পক্ষ থেকে আসছে এলান "যাচ্ছে গাড়ি মায়ার বাড়ি/ মায়ার বাড়ি ইস্টিশন/ গাড়িতে এক যাত্রী আছে/ খুবই যে তার মিষ্টি মন/..... তিনি আরো বলেন "যাচ্ছে গাড়ি মায়ার বাড়ি/ নিয়ে খুবই গতিবেগ/ যাত্রী মনে উঠছে দুলে/ শিশু শিশু ভাব আবেগ/ (মায়ার বাড়ি ইস্টিশন)। শিশু শিশু ভাব আবেগ মতিহার চল্লিশখানা ছড়া নিয়ে যাত্রা তার ছড়াগ্রন্থ "মায়ার বাড়ি ইষ্টিশন " নামক গ্রন্থখানার। কবি এখানে ভাষা,শব্দ, ছন্দ প্রয়োগে শিশু পাঠকের মননের প্রতি সদা স্বচেষ্ট। একেকটি রচনায় কবি নিজেও হয়ে যান একজন শিশু। তাই তিনি অতি শৈশবিক আবদারে বলেন " কাকা আমার কাকা/ তোমার সাথে যাব আমি ঢাকা/..... কাকা আমার কাকা/ তোমার বাসায় হবে আমার থাকা? /(কাকা আমার কাকা)
এভাবেই এগিয়ে চলছে তার ছড়ার ট্রেন। গন্তব্যের দিকে যেতে যেতে তিনি অবলোকন করেন তার পারিপার্শ্ব। তিনি তার ট্রেনে থেকেই দেখতে থাকেন পাখি, ফুল, বৃক্ষ। কবি জানে আলম গভীরভাবে লক্ষ করেন গাছের সবুজ পাতায় টুনটুনির জীবন যাপন, দোয়েল পাখির ছোট্ট ছানার বেলকনিতে লাফালাফি, রংধনুর সাতটি রঙের বাহারে, এমনকি মায়ের নিত্য দিনের কর্মময় জীবনে, মমতায় খোঁজে পান স্রষ্টার সৃষ্টির রহস্য। কবির বইটির উদ্দিষ্ট পাঠক শিশু কিশোর। তাই তিনি স্রষ্টার সৃষ্টি রহস্য বর্ণনায় ব্যাবহার করেছেন শিশুসাহিত্যের তুলতুলে ভাষা,শিশুকিশোরের বোধগম্য ভাষা। তিনি লিখেন "আম্মু আমার চা বানালে/ ভারি মজা হয়।/ চায়ের স্বাদে দেহ ও মন/ চাঙ্গা হয়ে রয়।/..... আমি কেবল যাই থেমে যাই/ আম্মু দিলে ডাক।/ কিযে মধু দিলেন তাতে/ মহান আল্লাহ পাক। ( কি যে মধু দিলেন)।
মানবতা আজ দেশে বিদেশে সারাবিশ্বে ভূলুন্ঠিত। মানবতার প্রশ্নে কবির জিঙ্গাসা "তুমি কেবল নিজে খেলে/ অন্যে উপোস র 'ল/ মানবতার সেবা তোমার / কেমন করে হল।/ (লোকে বলবে বাজে)। স্রষ্টার প্রেমে নিমজ্জিত কবি খবর দেন প্রথমত এক অচিন দেশের অতঃপর বলেন " অচিনপুরের কথা রেখে সত্য দেশের কথা কই/ সে দেশেরই জানবে কথা যখন তুমি পড়বে বই/। সেই দেশেই বয়ে গেছে একটি নদী সালসাবিল/ পানি হল অপূর্ব স্বাদ নামটি হল জানজাবিল।/( সত্য দেশের কথা)
বই, বইমেলা, নতুন বইয়ের ঘ্রাণ একজন লেখকের মুগ্ধতার বিষয়। লেখক সত্তাকে আকৃষ্ট করে সব সময় এসব। প্রকৃতির ঋতু পরিক্রমায় বসন্ত আসে। আবার চলে যায়। কিন্তু একটি বইয়ে মুদ্রিত রূপ রস অমলিন। তা থেকে যায় যুগ যুগ। কবির ভাষায় "নিসর্গে তো ফাগুন আসে/ আবার চলে যায়/ বইয়ে থাকে চির ফাগুন/ অভিনবতায়।/ (নতুন বইয়ের ঘ্রাণ)। কবির এ বইয়ে রচিত পঙক্তিমালা মূলত ছড়াধর্মী। এই বইয়ের পাঠকের কাছে ছড়াকার জানে আলমের নিবেদন "এসো সবাই ছড়া পড়ি / জীবন গড়ি ছন্দময়/ সবার সাথে থাকি মিলে/ ঝগড়া ঝাটি দ্বন্দ্ব নয়/।(এসো সবাই ছড়া পড়ি)।
জানে আলমের কবিতার শরীরে সালাত, কায়েম, আকামত, তাহরিমা, নুর, আল্লাহ, রাসুল, মোহর, প্রভৃতি প্রচলিত বিদেশী শব্দরাজির ব্যবহার কবিতার সাবলীলতাকে কোথাও বিঘিœত করেনি। বরং তার এসব শব্দের যথাযথ প্রয়োগ বিশ্বাস ও ঐতিহ্যিক সমন্বয় সাধিত হয়েছে। তবে কখনো কখনো অপ্রচলিত আরবি শব্দের প্রয়োগ কবিতা ও পাঠকের মাঝে সম্পর্কের দূরত্ব তৈরী করেছে। কবিকে এ বিষয়ে খেয়াল রাখা প্রয়োজন। পাঠক যখন পাঠ করে "মিষ্টি খেজুর দিয়ে তাকে / করাও তাহনিক/ অথবা চাঁদটা বলে খোকা তোমার দূর করাতে 'আহযান 'তখন কিছুটা হলেও অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। একজন শিশু জাতির ভবিষ্যত। বলা হয় শিশুরা নরম কাদামাটির মতো। তাদের যেভাবে গড়ে তোলা হবে তারা সেভাবেই গড়ে উঠবে। কবির আকাঙ্খা শিশুরা গড়ে উঠুক হেরার জ্যোতির স্পর্শে, বেড়ে উঠুক ইমানের দাবী আদায়ের পরিপূরক হয়ে। এজন্য প্রত্যেককে তাকওয়ার সাজে সজ্জিত হওয়া চাই,চাই আল্লার রঙে রঞ্জিত হওয়া। কবি তাই তার উদ্বিষ্টজনকে উদ্দেশ্য করে বলেন "তোমার মাঝে রং লাগাতে আল্লারই রং চাই/ সে রং ছাড়া অন্যকিছু নিছক মেকি তাই। (মুগ্ধ হবে সবাই)।
কবি জানে আলম ছন্দ সচেতন। অন্তমিলের সময় থাকেন সজাগ। তবু মাঝে মধ্যে হয়তো মনের বেখেয়ালে অন্তমিলের ধারাবাহিকতার ব্যতিক্রম ঘটে। ছড়াকারের চোখ ফাঁকি দিয়ে মুদ্রিত হয়ে যায় দু 'একটি দুর্বল অন্তমিল।"গাছে গাছে ফুলের হাসি / কর হাসির তর্জমা/ পোকা খেকো পাখির মতো/ খোঁজো না তো নর্দমা/(লিপ্ত কেনো কান্নাতে)।কিংবা কবির অন্য লেখায় পড়ে দেখতে পারি "আম্মু প্রিয়,আব্বু প্রিয়/ সবার প্রিয় কে?/ ভাইয়া বলে প্রশ্ন কেনো/ করছো আমাকে? /( সবার প্রিয়) এসব বিষয় সতর্ক পদক্ষেপ জরুরী।
সম্প্রতি আমার হাতে এসেছে তরুণ কবি ও শিশু সাহিত্যক জানে আলম এর ছড়াগ্রন্থ ‘মায়ার বাড়ি ইস্টিশন’। বইটি ফেব্রুয়ারি ২০১৯-এ মেলায় আনছে প্রতিশ্রুতিশীল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান প্রতিভা প্রকাশ। ছড়াকার তার বইয়ের শিরোনাম দিয়েছেন প্রথম ছড়াকে কেন্দ্র করেই। প্রতিদিনকার ব্যস্ত স্টেশনে আমরা রেখে যাই কিছু স্মৃতি, বেদনা, ভালোবাসা কিংবা কিছুটা মায়া। বোধ হয় এ কারণেই ছড়াকার ইস্টিশনকে ‘মায়ার বাড়ি’ নামে ডেকেছেন। তেমনি মাকে নিয়ে লেখা ছড়াটিতে সুন্দর এক মাতৃবন্দনা ফুটে উঠেছে যেন। পৃথিবীর প্রত্যেক সন্তানের কাছেই মায়ের ডাক শোনা যেনো অমৃতের স্বাদ পাওয়া। তাই দেখি, জননীর সুমধুর কণ্ঠের গুণ-কীর্তন ছড়াকার এভাবে করেছেন ‘আমি কেবল যাই থেমে যাই/ আম্মু দিলে ডাক/ কী যে মধু দিলেন তাতে/ মহান আল্লাহ পাক’। বইয়ের আরেকটি চমৎকার ছড়া ‘জান্নাতে বিয়ে’। এই ছড়া নিয়ে আলাদা ভাবে একটু লিখতেই হয়। ইসলাম ধর্মমতে সৃষ্টির আদি পুরুষ ও নারী আদম-হাওয়া’র বিবাহোৎসবে স্বয়ং স্রষ্টা উপস্থিত ছিলেন এমন কথা-ই এই ছড়াতে তুলে ধরা হয়েছে। বিবাহোৎসবের আনন্দ এমনই পরিপূর্ণ ছিল যে ছড়াকার বর্ণনা দিলেন ‘ফেরেশতারা আনন্দে খুব/ তুবা গাছের তলে/ করেছিল ফূর্তি সবাই/ এসে দলে দলে’। বইটি পাঠ করে একটা জিনিষ চোখ এড়ালো না; ৪০টি ছড়ার মধ্যে ১৪/১৫টি ছড়া একটু আলাদা ঘরানার। এই ছড়াগুলোতে হয় স্রষ্টার বন্দনা করা হয়েছে, কোনোটিতে প্রিয় নবী মুহম্মদ (স.) এর কথা বলা হয়েছে। যেমন ‘তোমার মনন মাঠ’ ছড়াতে স্রস্টার পাশাপাশি তাঁর প্রিয় হাবিব মুহম্মদ (স.) এর কথাও এনেছেন এভাবে ‘চাইলে পূত রাখতে তুমি/ তোমার মনন মাঠ/ আমার নবীর নামে তবে/ দরুদ করো পাঠ’। কিংবা কোনো কোনো ছড়াতে ধর্ম ও স্রষ্টাকে আশ্রয় করে কোমলমতি শিশুদেরকে নৈতিকতার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে তার ছড়াতে মানবিক বিষয়টিও সুন্দর ফুটে উঠেছে। সে কারণেই হয়তো ‘ফর্সা মানুষ’ ছড়াতে মানুষের হৃদয়ে জমে থাকা ময়লার কথাও স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। শিশুদেরকে বই পাঠে আকৃষ্ট করে লেখা ছড়া ‘নতুন বইয়ের ঘ্রাণ’ খুব সুন্দর হয়েছে। আশা করি এ ছড়া পাঠের মাধ্যমে শিশুমন বই পড়ার উপকারিতা সম্পর্কে একটা ধারণা পাবে। তবে এ ছড়ার বইটি পড়তে যেয়ে আমি একটু অবাকও হয়েছি। ছড়াগ্রন্থটির টার্গেটেড পাঠক শ্রেণি যেখানে শিশুরা; সেখানে ‘তাহনিক’ বা ‘আহযান’ এর মতো অপরিচিত, ভিনদেশী শব্দ ব্যবহার করা একেবারেই উচিত হয়নি। এই শব্দদ্বয়ের সাথে পরিপক্ক পাঠকেরও পরিচয় নেই বললেই চলে। ছড়াকার কোন উদ্দেশ্য মাথায় রেখে এমনটি করেছেন তা হয়তো তিনিই জানেন। এছাড়া কিছু দুর্বল অন্ত্যমিল ছড়ার সৌন্দর্যকে কিছুটা নষ্ট করে দিয়েছে বলে আমি মনে করি। যেমন- ইস্টিশনের সাথে মিষ্টি মন, তর্জমার সাথে নর্দমা কিংবা জেয়ারত/ নেয়ামত, চিরদিন/শংকাহীন, দেন/জ্ঞান ইত্যাদি। এক ছড়ায় ‘ক্ষমতাবান’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলা ভাষায় বহু বহু শব্দ রয়েছে যেগুলো ছড়ার শব্দ না বা ছড়ার সাথে ওই শব্দগুলো যায় না। বিষয়টি ছড়াকার মাথায় রাখবেন আশা করি। বইটিতে আরও কিছু ঝরঝরে, ফুরফুরে বা চনমনে ছড়া রয়েছে। সেগুলো হলো ‘সত্য রঙে আঁকতে’ ‘সবুজ পাতার কথা’ টিয়ের মোবাইল’ ও ‘সবার প্রিয়’ ইত্যাদি। ছড়াগ্রন্থটি শিশুমনে দাগ কেটে যাবে; সবশেষে এটুকুই প্রত্যাশা।