“জাপান যাত্রী" বইটির ফ্ল্যাপ এর লেখাঃ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে জাপানের সম্পর্কের শেকড় গভীরে প্রােথিত। ১৯১৬ সালে প্রথমবার জাপানভ্রমণে যে-বাণী জাপানিদের রবীন্দ্রনাথ শুনিয়েছিলেন, সেদেশের নেতৃস্থানীয় অনেক বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকের তখন সেটা পছন্দ হয়নি। ফলে আপ্যায়ন জানিয়ে জাপানে নিয়ে। আসার ঠিক পরপরই রবীন্দ্রনাথকে অবজ্ঞা করার একধরনের মনােভাব জাপানের একশ্রেণির বুদ্ধিজীবীর মধ্যে দানা বেঁধে ওঠে। তবে সম্পর্কের এই টানাপােড়েন সত্ত্বেও জাপানকে যে রবীন্দ্রনাথ সত্যিকার অর্থে ভালােবেসেছিলেন, তাতে কোনাে সন্দেহ একেবারেই নেই। ভালােবাসার উৎস অবশ্যই হচ্ছে জাপানের নান্দনিক উত্তৰ্ষ এবং সমৃদ্ধ শৈল্পিক বােধ সম্পর্কে অবগত হতে পারা। রবীন্দ্রনাথ যখন প্রথমবারের মতাে জাপানভ্রমণ করেন, বিশ্বজুড়ে তখন চলছিল সর্বনাশা এক যুদ্ধ। এশিয়া সরাসরি সে-যুদ্ধে জড়িত না হলেও এশিয়ার কিছু কিছু এলাকায় পরােক্ষ সংঘাত রক্তক্ষয়ী আকার নিয়েছিল। অন্যদিকে আধুনিকতার পথ ধরে এগিয়ে চলা জাপানেও চলছিল সমরপ্রস্তুতি। এতদিন পর্যন্ত জাপানকে রবীন্দ্রনাথ দেখে এসেছিলেন পশ্চিমের দেখা-চোখ ধার করে নিয়ে । জাপান যাত্রী বিশুদ্ধ অর্থে কোনাে ভ্রমণকাহিনি। নয়। বরং এটা হচ্ছে জাপান সম্পর্কে কবির ভাবনা-চিন্তা তুলে ধরা এক ভ্রমণবৃত্তান্ত। জাপান। যাত্রী সত্যিকার অর্থেই যেন হয়ে উঠেছে জাপানের প্রতি যে-ভালােবাসা রবীন্দ্রনাথ বরাবর অনুভব করে গেছেন তারই সবচেয়ে বিশ্বাসযােগ্য দলিল।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, চিত্রশিল্পী, সংগীতস্রষ্টা, অভিনেতা, কন্ঠশিল্পী, কবি, সমাজ-সংস্কারক এবং দার্শনিক। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য প্রথম বাঙালি হিসেবে ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে তৎকালীন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে কলকাতার ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিমনা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ভানুসিংহ ঠাকুর ছিল তাঁর ছদ্মনাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই মানেই এক মোহের মাঝে আটকে যাওয়া, যে মোহ পাঠককে জীবনের নানা রঙের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয় নানা ঢঙে, নানা ছন্দে, নানা সুর ও বর্ণে। তাঁর ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাট্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর কিছুদিন পরই আলোর মুখ দেখে। কাবুলিওয়ালা, হৈমন্তী, পোস্টমাস্টারসহ মোট ৯৫টি গল্প স্থান পেয়েছে তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থে। অন্যদিকে ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ১,৯১৫টি গান। উপন্যাস, কবিতা, সঙ্গীত, ছোটগল্প, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনীসহ সাহিত্যের সকল শাখাই যেন ধারণ করে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমূহ। তিনি একাধারে নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা দুই-ই ছিলেন। কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া তিনি চিত্রাংকনও করতেন। তৎকালীন সমাজ-সংস্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমগ্র। তাঁর যাবতীয় রচনা ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে ত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। আজও আমাদের বাঙালি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে বিশ্বকবির সাহিত্যকর্ম।