ফ্ল্যাপে লিখা কথা বিংশ শতাব্দীর তিন-চতুর্থাংশ জুড়ে আমাদের এই ধরনীতে দৃপ্ত পায়ে হেঁটেছিলেন একজন সন্তোষ গুপ্ত। শেষ ছয়টি দশকে তিনি নিজেই ছিলেন প্রথমে বাঙালির বিভাজন ও পরে স্বাধীন বাংলা অভ্যুদ্বয়ের রঙ্গমঞ্চের একজন কুশীলব। তিনি তিনটি পতাকার নিচে বাস করা তাঁর জীবন, চিন্তা ও মনন সাধারণ বাঙালির চিন্তাস্রোতের গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসানো নয়; বরং সময়ে চেয়ে অগ্রসর। ব্যতিক্রমী চিন্তাধারার আলোকবর্তিকা নিয়ে সমাজ-জাতিকে পথ দেখিয়েছেন সন্তোষ গুপ্তরা। সরকারী কর্মচারী হয়েও রাজনৈতিক কর্মী এবং সেখান থেকে অগ্রণী সাংবাদিকে রূপান্তর; পাশাপাশি অসংখ্য নিবন্ধ ও কবিতার জনক- এসবই ঘটেছে সন্তোষ গুপ্তের এক জীবনের মধ্যে।
সংবাদপত্র জগতে ষাট ও সত্তরের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সন্তোষ গুপ্তের পদচারণা সংবাদকক্ষে। সত্তরের দশকের শেষদিক থেকে একুশ শতকের প্রথম বছর পর্যন্ত তিনি মূলত ভাষ্যকার ও বিশ্লেষক; কখনো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া সমালোচক; কখনো বা ভবিষ্যত-দ্রষ্টা। এসবের প্রকাশ ঘটেছে তাঁর সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয়, কলাম ও নানা নিবন্ধে। ‘অনিরুদ্ধের কমা’ তার মধ্যে আলোক-উজ্জ্বল স্তম্ভের ন্যায়। সত্তর ও আশির দশকে বাংলাদেশে সামরিক শাসন ও স্বৈরতন্ত্র এবং বাঙালির আবহমানকালের প্রবাহমান সাংস্কৃতিক গতিধারাকে বিভ্রান্ত করার প্রয়াস; নব্বইয়ের দশকে গণতন্ত্রে উত্তরণের বিপুল আশাবদ ও বারংবার হোঁচট্ খাওয়া এবং উত্তরোত্তর সংকট-দুনীতি-আত্মপ্রবঞ্চনার ছোবলে হতাশ সমাজ। অন্যদিকে বিশ্ব রঙ্গমঞ্চে সমাজতন্ত্রের স্বপ্নের অবিশ্বাস্য পতন এবং পুঁজিবাদী আগ্রাসন ও বঞ্চনার আরো সূক্ষ্ম রক্তাক্ত ছোবলের বিস্তার। এসবের ছায়া ভরে আছে অনিরুদ্ধের কলামে। রাজনীতি-সমাজ-সংস্কৃতিকে একসুতোয় গেঁথে আমাদের মনোলোকে চক্ষু উম্মোচনে “অনিরুদ্ধের কলাম” এক অসাধারণ অবদানে ভাস্বর। সন্তোষ গুপ্তের তীক্ষ্ন ইতিহাসবোধের ছায়ায় অনিরুদ্ধের কলাম স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সিকি শতাব্দীর চলন্ত ইতিহাস। তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা একজন কবির ভাষা ও ভঙ্গির জন্য “অনিরুদ্ধের কলাম” একই সঙ্গে অপূর্ব সাহিত্যরূপ।
সন্তোষ গুপ্ত। প্রয়াত এই যশ্বসী প্রতিভা জন্মেছিলেন ঝালকাঠি জেলার রুনসী গ্রামে। বাবা-মা’র একমাত্র সন্তান সন্তোষ গুপ্ত (১৯২৫- ২০০৪) সাংবাদিকতায় আসেন ১৯৫৭ সালে। তারপর দৈনিক আজাদ , দৈনিক সংবাদ-এর বিভিন্ন পদে বিভিন্ন সময় কাজ করেছেন। অর্থাৎ সব কাজে যেমন তিনি প্রাজ্ঞ ছিলেন তেমনি পড়াশুনার জগৎটাও ছিলাে বিশাল। আর এ কারনে তিনি সবার অগােচরেই একটি আশ্রয়- একজন সন্তোষদা হয়ে উঠেছিলেন সবার কাছে। ধর্ম, রাজনীতি, দর্শন, শিল্পকলার বিভিন্ন দিকে তাঁর ছিলাে অবাধ বিচরণ। জেলখানার চাকরি করেছেন। করেছেন কমিউনিস্ট রাজনীতি। যে জন্য জেলখানার চাকরি করেও জেলের লৌহকপাটের মধ্যে জীবন কাটিয়েছেন প্রায় এক যুগ।। দেশের কোন গণসংগ্রামে সন্তোষ গুপ্ত পিছিয়ে ছিলেন না। কখনও তাঁর লেখা অনিরুদ্ধের কলাম আজও সংবাদপত্র জগত ও পাঠকদের কাছে সমাদৃত। এই মনীষী আমৃত্যু জীবনের বাঁকে বাঁকে নতুনের সন্ধান করে গেছেন। কবিতা, প্রবন্ধসহ গদ্য-পদ্য রচনায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তাঁর লেখা বইয়ের মধ্যে অনুত্তম বক্তব্য, অনালােকে আলােকস্তম্ভ, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বনাম সাংবাদিকতা, ইতিহাস আমাদের দিকে, ইতিহাসের ঝর্ণাধ্বনি, বাংলাদেশের চিত্রশিল্পের স্বরূপের সন্ধান, শিল্প সমাজ ও বাস্তবতা, অসমাপ্ত কবিতা, একুশের চেতনা ও আজকের বাংলাদেশ উল্লেখযােগ্য। সন্তোষ গুপ্ত সাংবাদিকতা জগতে একটি প্রতিষ্ঠানের নাম। তাঁর জীবন বীক্ষা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দিতে পারলে এই দুঃসময়ে একজন দেশপ্রেমিক তৈরি করতে খুব কষ্ট হবে না ।