"ওঙ্কার" বইয়ের ভেতর থেকে: আহমদ ছফা সাহিত্যচর্চা শুরু করেন উপন্যাস দিয়ে। বেশ কয়েকটা ছােটো গল্প লিখে হাত মসকের করার প্রচলিত নিয়মটি তিনি মানেননি; তাঁর প্রকাশিত প্রথম বইটিও একটি উপন্যাস। ছফার উপন্যাস আকারে ছােটো হলেও কোনােটাই কিন্তু ছােটো গল্পের সম্প্রসারণ নয়, এগুলাে একেবারেই উপন্যাস। চেনাজানা জীবনের ভেতরের ব্যাপারটা নানা দিক থেকে দেখার দায়িত্ব নিয়ে সমাজ ও রাজনীতির ভাঙাচোরায় কাজ করছে কোন রহস্য, তারই অনুসন্ধানে ছফা নিয়ােজিত। সুখ ও স্বস্তি জলাঞ্জলি দিয়ে তিনি কাজ করেন এমন সব পরিবেশ নিয়ে যা বেশির ভাগ সময়ে তার স্বভাবের অনুকূল নয়। পাঠককে তিনি পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন যাদের সঙ্গে বেশির ভাগ সময়েই তিনি নিজে বা তাঁর পাঠকরা তাদের পছন্দ করেন না; অন্তত তাদের অনেক কাণ্ডকীর্তিতে সায় দেওয়া মুশকিল। সেই খুচরােখাচরা ও টুটাফাটা মানুষের একেকটা আস্ত চেহারা তৈরি করতে ছফাকে রীতিমতাে যুদ্ধ করতে হয় এবং পাঠককে তিনি উস্কে দেন এ যুদ্ধে নেমে পড়তে। ‘ওঙ্কার’-এ আহমদ ছফা গপ্পো ফাঁদতে বসেননি, কাহিনীর সত্র ধরে পাঠককে তিনি টেনে নেন এমন একটি জায়গায় যেখানে পৌছে গল্পটা ভুলে গেলেও কিছু এসে যায় না, কাহিনী গৌণ হয়ে সেখানে প্রবল হয়ে ওঠে অনেক দিনের মানুষ গ্লানি, জড়তা ও শােষণ এবং গ্লানি থেকে মুক্তির রক্তাক্ত সংকল্প।
বাঙালি মুসলিম লেখকদের মধ্যে অন্যতম কীর্তিমান কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফা একাধারে ছিলেন কবি, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক, গণবুদ্ধিজীবী ও চিন্তাবিদ। বাবা-মায়ের দ্বিতীয় সন্তান আহমদ ছফা জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৩ সালের ৩০ জুন, চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া গ্রামে। নিজ এলাকায় তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়, এবং ১৯৫৭ সালে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত হন এবং মাস্টারদা সূর্যসেনের আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হলেও সেখানে পড়ালেখা শেষ করেননি, এবং জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের অধীনে পিএইচডি শুরু করলেও তা আর শেষ করা হয়ে ওঠেনি। আহমদ ছফা এর বই সমূহ বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পাঠকদের মধ্যে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বই হিসেবে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা প্রবন্ধগ্রন্থ ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’। আহমদ ছফা এর বই সমূহের মাঝে 'ওঙ্কার', 'অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী', 'বাঙালি মুসলমানের মন', যদ্যপি আমার গুরু', 'গাভী বিত্তান্ত' প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য কীর্তি হলো জার্মান সাহিত্যিক গ্যাটের অমর সাহিত্যকর্ম 'ফাউস্ট' বাংলায় অনুবাদ করা। আহমদ ছফা এর বই সমগ্র একত্রিত করে রচনাবলি আকারে ৯টি খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানবিরোধী এই সাহিত্যিক 'লেখক শিবির পুরস্কার' ও বাংলা একাডেমির ‘সাদত আলী আখন্দ পুরস্কার’ পেলেও সেগুলো গ্রহণ করেননি। এই পাঠকনন্দিত সাহিত্যিক ২০০১ সালের ২৮ জুলাই ৫৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক মরণোত্তর 'একুশে পদকে' ভূষিত হন।