মুখবন্ধ বনফুল তাঁর সমকালের বাংলা সাহিত্য ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র প্রতিভা হিসাবে সর্বজন স্বীকৃত। তাঁর স্বাতন্ত্র্যের মূলে রয়েছে তাঁর রচনার চমৎকারীতা। কবিতা-গল্প-উপন্যাস-নাটক সর্বত্রই তাঁর ভাবনার গভীরতার চেয়ে চমকপ্রদতাই প্রধানভাবে অনুভূত। বস্তুতঃ বনফুল রচনার বৈশিষ্ট্যের উৎস খুঁজতে তাঁর রূপদক্ষতার প্রসঙ্গই বারবার বিবেচিত হয়েছে । বলাবাহুল্য যে, রচনার বৈচিত্র্য তথা চমকপ্রদতার প্রতি সাধারণ পাঠকের আকর্ষণ অপেক্ষাকৃত বেশী ; তাহলেও বলব বনফুল কেবল রূপচমৎকৃতির শিল্পীই নন, তাঁর মধ্যেও ছিল জীবন প্রেম, জীবননিষ্ঠা। আর এইখানেই তিনি আকৃষ্ট করেছেন আমাকে। বিশেষ করে বনফুলের বেশ কিছু গল্প আর প্রবন্ধ পড়ে আমার মনে হয়েছে বিস্ময়কর কলারীতির সঙ্গে মননের একটা সহজাত প্রবণতাও তাঁর মধ্যে ছিল। এমনকি রচনা-বিশেষে কলাকৃতির মুগ্ধতাকে ছাপিয়ে মননের উদ্ভাস স্পষ্টই চোখে পড়েছে । বস্তুতপক্ষে বনফুলের সৃষ্টির মূলে ছিল তাঁর জীবনবোধের অভিনবত্ব। রবীন্দ্রনাথ যাকে ‘বিজ্ঞানী মেজাজের’বলেছিলেন ” তার সঙ্গে বনফুলের এই জীবনবোধের অনন্যতা জড়িয়ে গিয়ে গড়ে উঠেছিল তাঁর সৃজনকর্ম। আবার এই জীবনবোধেরই মূলে রয়েছে প্রত্যক্ষ জীবন অভিজ্ঞতা। বাস্তবিকভাবেই বনফুল এমন একটি লেখাও লেখেন নি যা তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালব্ধ নয়, অভিজ্ঞতার আধারেই নিরন্তর প্রবাহিত হয়েছে তাঁর বিচিত্রমুখী রচনা ধারা। কিন্তু তাহলেও বলা যায় তিনি কখনোই নিজের রচনায় নিজেকে প্রতিফলিত করেন নি, বরং আত্মসংবরণ করার এক বিচিত্র কৌশল অনুসরণ করেছিলেন – যাতে ‘করণ কৌশল'-এর চমকপ্রদতার আড়ালে শিল্পী তাঁর ব্যক্তিগত ভাবনাকে নিয়ে প্রচ্ছন্ন হতে পেরেছিলেন। বলা বাহুল্য, এই সচেতন অভীষ্ঠ সাধনায় বনফুল এক আশ্চর্য সাফল্য লাভ করেছিলেন। কবিতার ব্যঙ্গতীক্ষ্ণ কৌশল, ছোটগল্পের চমকপ্রদতা, উপন্যাসে ঘটনার দ্রুতগতিশীল চলমানতা তথা ব্যক্তিত্বের নৈর্ব্যক্তিক রূপরচনা – এ সবই বনফুলের ব্যক্তিক অনুভবকে ঢেকে রেখেছে সংগোপনে। এছাড়াও প্রবন্ধগুলির মধ্যে আপাতমননের অন্তরালে লেখকের ব্যক্তিসত্তাকে গোপন করার প্রয়াসও আনুপূর্বিক ।